লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় নেতৃত্বের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশেষত, বিভিন্ন পুরসভায় ফলাফল খারাপ হওয়ায় ব্যাপক কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে। প্রায় ছয় মাস পর, তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) পুরসভাগুলির নেতৃত্বে বড় রদবদলের প্রস্তাব দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর। এর অর্থ, একাধিক পুরপ্রধান, কাউন্সিলর এবং অন্যান্য নেতৃত্বের পদে পরিবর্তন হতে পারে। আনুমানিক ১২৫টি পুরসভায় এই রদবদল হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
প্রথমেই আসা যাক, কেন পুরসভাগুলির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে দলের মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং ব্যর্থতাকে কোনওভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। পুরসভার নির্বাচনে যদি দলের ফলাফল খারাপ হয়, তবে সেই নেতৃত্বের ওপর ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এটি শুধুমাত্র দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য নয়, বরং দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজ্যের ৬৯টি পুরসভায় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এই প্রবণতা কলকাতাতেও প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও কলকাতার দু’টি লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল জিতেছে, তবুও ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৮টি ওয়ার্ডে তারা বিজেপির থেকে পিছিয়ে ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কলকাতা পুরভোটে ১৩৭টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে সেই ফলাফলের সাথে তুলনা করলে, পরিস্থিতি কিছুটা অবনতিশীল মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এত পুরসভায় পরিবর্তন আসলেও কেন কলকাতা সেই তালিকায় নেই? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে চারটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছেন:
১. প্রধান শহরের গুরুত্ব: কলকাতা শুধু একটি শহর নয়, এটি তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এখানকার যেকোনও পরিবর্তন রাজ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য নেতারা বিশ্বাস করেন যে কলকাতার পুরসভার নেতৃত্বের পরিবর্তন করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
২. ভোটের সময়সীমা এবং প্রস্তুতি: ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল কংগ্রেস কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চায়। কলকাতার পুরসভায় বড় রদবদল করলে দলের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা নির্বাচনের আগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং, এই মুহূর্তে কোনও পরিবর্তন না করে, দলের নেতারা স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
৩. সাংগঠনিক জটিলতা: কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে কোনও ওয়ার্ডেই বড় ধরনের পরিবর্তন করা একটি জটিল কাজ। রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বাস করেন যে সময় ও সুযোগ বিবেচনা করে রদবদল করার পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
৪. জনমতের প্রতিক্রিয়া: কলকাতার মানুষ অনেকটাই দলীয় নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখেন। তাই হঠাৎ করে বড় রদবদল করলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। জনমতের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি দলের নেতারা বিবেচনা করছেন।
তৃণমূলের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পুরসভাগুলিতে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে দলকে নতুনভাবে গঠন করতে চাইছে। এটি দলীয় শৃঙ্খলা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, এই রদবদল শুধুমাত্র নেতৃত্ব পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের মনোবল বাড়াতে এবং পুরসভাগুলির কার্যকারিতা আরও উন্নত করতে চাইছেন।
তৃণমূলের প্রধান লক্ষ্য হলো আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে শক্তিশালীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং বিজেপির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দল কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পুরসভাগুলির নেতৃত্বে পরিবর্তনের মাধ্যমে দলের মধ্যে একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, তৃণমূল কংগ্রেস ব্যর্থতাকে কোনওভাবেই সহ্য করবে না এবং নিজেদের সঠিক পথে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
এখন দেখার বিষয় হলো, এই রদবদল কতটা কার্যকর হবে এবং তৃণমূল কংগ্রেস আসন্ন নির্বাচনে কিভাবে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে।