গাড়িতে যেন নতুন করে পেট্রোল-ডিজেল দেওয়া হয়েছে: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Sanjib Chattopadhyay

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত নাম। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্ম। মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং হুগলি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। বহু উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধের রচয়িতা। তাঁর রচনায় হাস্যরসের সঙ্গে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ মেশানো থাকে– এটাই তাঁর লেখার বৈশিষ্ট। ছোটদের জন্য লিখেছেন অনেক। ‘লোটাকম্বল’ তাঁকে তুমুল জনপ্রিয়তা দিয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন’ বইয়ের জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। সেই সময় এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় বরাহনগরে লেখকের বাসভবনে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরুণাভ রাহারায়

Advertisements

অরুণাভ: সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে?
সঞ্জীব: প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। হ্যাঁ ভালোই লাগছে। বেশ একটা কেমন কেমন লাগছে। এ প্রসঙ্গে বলি– এতকাল হাতুড়ে চিকিৎসক ছিলাম তো; এবার যেন পাশকরা ডাক্তার হলাম আর কি! এর আগে অনেকেই বলতো কী কী পুরস্কার পেয়েছেন? দুঃখের সুরেই বলতাম কোনো বড়ো পুরস্কার তো পাইনি! আসলে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের কথাই সকলে শুনবে; এমন এক ট্রেন্ড আছে চিরকালই। এই পরিসরে এক মজার কাহিনি বলি। আমি এক জ্যোতিষীকে বলি আপনি তো বলেছিলেন, আমি মস্ত বড়ো পুরস্কার পাব! কোথায়? তখন তিনি বলেন, একজনের কুষ্টি দেখে বলেছিলাম– তুমি লটারিতে বড়ো পুরস্কার পাবে। সে গিয়ে পাড়ার লটারিতে এক টাকার লটারি কেনে এবং প্রথম পুরস্কার পায়। সেই পুরস্কার ছিল এক নাগড়ি গুড়! আমারও নাকি এমনই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তুমি পাড়ার দুগ্গাপুজোয় বিচারক হয়ে গিয়ে গলায় একটা ব্যাচ ঝুলিয়ে ঘুরেছো। এতে তোমার বড় পুরস্কারের ভাগ্য নষ্ট হয়েছে! তারপর ভাবলাম পুরস্কার পাওয়ার জন্যই লিখতে হয় বুঝি!

অরুণাভ: লেখালিখির বাইরে আপনার অবসর যাপন….
সঞ্জীব: কলকাতায় এই বাড়িতে আসার পর এখানে অনেক বড় বড় গাছের সমাহার দেখা যেত! আমি এবং আমার পিতৃদেব মাটির চালুনিতে চেলে সহজেই ভূমিজাত কিছু গাছ লাগিয়েছি। এরপর কৃষ্ণচূড়া, আম, চেরি গাছ! পরবর্তীতে কেটে ফেলতে হয়! আগে মরশুমি ফুলের প্রস্ফুটনে পুরো বাগান ফুলে ছয়লাপ হয়ে যেত। এখন বাড়িতে একা হয়ে যাওয়ায় তেমন পরিচর্যা করা হয় না। এক টব এখান থেকে ওখানে সরিয়ে কেবন টব স্থানান্তরের খেলা চলে। বর্ষায় এই সব টব জলে টুইটুম্বর হয়ে যায়। এই সব গাছ এক এক স্মৃতি। বাগানে একটা গুলঞ্চ গাছ আছে। আমার বাবা গঙ্গার জল থেকে তার ডাল পুঁতেছিলেন। সেটা এখনও আমাদের বাড়িতে আছে।

অরুণাভ: আপনার কি মনে হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেতে অনেক দেরি হয়ে গেল?
সঞ্জীব: এই আক্ষেপটা আমার পাঠক-পাঠিকাদের। যারা আমার লেখা ভালোবাসে। আমি এক বিষয় আবিস্কার করলাম, আমি মহানন্দে শুধুই লিখে গিয়েছি। সেই লেখা পাঠক-পাঠিকাদের হৃদয় জয় করেছে। তাই পুরস্কারের চিন্তা ছিল না। কিন্তু এই যে পুরস্কার এল, যেন এক প্রবল উচ্ছ্বসের মতো! পুরস্কার ঘোষণার পর সারারাত কিছু সময় ঘুমিয়েছি। যারা আরও কম বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছে, সেই পুরস্কারে এখন ঘুণ ধরে গিয়েছে। ঘুণ ধরেছে লেখকের কর্মজীবনেও। সাহিত্য আকাদেমি পাওয়ার পর আমার মনে হল গাড়িতে যেন নতুন করে পেট্রোল-ডিজেল দেওয়া হয়েছে। এবার উদ্যোম গতিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। হ্যাঁ, এটাই আমার বড়ো পাওয়া। বেলুড় মঠের মহারাজ এই দেরি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন। আমি বলি, মহারাজ দেরি হওয়াই ভালো। আসলে জীবনের শেষ ভাগটা খুব শুকনো। বন্ধুবান্ধবহীন জীবনে একাকীত্ব চলে আসে। শেক্সপিয়ার বলেছেন, suns shine, sun steingth, suns availability. গৃহবন্দি জন্তু হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে এই পুরস্কারটা এলো। আমি ঠাকুরমা স্বামীজিকে বিশ্বাস করি, তাঁরাই হয়তো এটা আটকে রেখেছিল এতদিন…

অরুণাভ: শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে, ‘দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালোবাসি তাকে।’ ব্যাপারটা তেমনই তো?
সঞ্জীব: হ্যাঁ একদম। আর দেরি করে যে এসেছে সে তো যুবতী নারী, বৃদ্ধা নয়। সেই নতুন প্রেম, নতুন করে ভালোবাসা…..

Advertisements

অরুণাভ: আপনার লেখায় ও জীবনে রামকৃষ্ণ, সারদা মা এবং স্বামীজির প্রভাব প্রভাব লক্ষ্য করা যায়
সঞ্জীব: এ এক মস্ত বড়ো গল্প। আমি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পাশ করে অবসর সময়ে দর্শনের অনেক বই পড়তে লাগলাম এক সময়। তার মধ্যে ছিল, ভ্যান গখের মতো দার্শনিকদের বইও। আমাদের বাড়িতে এমন শিক্ষা দেওয়া হত, যা কিছু পড়বে, পরে যেন সেটা কাজে লাগে। সেই ভাবনায় দীক্ষিত হয়ে আমি জীবনের প্রথম লেখা লিখলাম ‘মানুষ’। যার প্রথম লাইনই ছিল ‘Man is a biped without wings’। মানুষ কে যতই দেবতা করে দেখানো হোক না কেন, আসলে সে এক জন্তু! সেই লেখা রামকৃষ্ণ মিশনের কাগজ ‘উদ্বোধন’-এ পাঠাই। কিছু দিন বাদে একটি চিঠি পেলাম। তাতে আমাকে দেখা করতে বলা হয়েছে। আমি গিয়ে সম্পাদক মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। উনি তো আমাকে দেখে হেসে অস্থির। আমি ভাবছি, এত খারাপ লিখেছি যে আমাকে ডেকে এনে উনি বুঝি হাসছেন! তাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম– কী ব্যাপার? উনি বললেন, তোমার প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, তোমার বুঝি অনেক বয়স! বড় বড় চুল থাকবে, চোখে বড় লেন্সের চশমা। কিন্তু এ তো দেখছি ছোট ছেলে! এর পর তাঁর সঙ্গে সখ্য তৈরি হল। সেই আমার এই জগতে প্রবেশ। এরপর দেওঘর বিদ্যাপীঠে পড়াতে গেলাম। সেখানে যাওয়ার কারণ অবশ্য ছিল। আমি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলাম। সে সময় এক সমস্যাও হল। কারণ, বাড়িতে বাবা ছাড়া কেউ নেই। তিনি আমার এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন? আমার গুরুদেব বললেন, তুমি যদি বলে সন্ন্যাসী হব, তা হলে উনি হয়ত আহত হবেন। তুমি বরং বলে, ওখানে শিক্ষকতা করবে। আমি সেই মতো ওনাকে জানিয়ে দেওঘর গেলাম। কিন্তু সন্ন্যাসী হওয়া আমার আর হল না। ঢুকে পড়লাম লেখার জগতে। এই পরিবেশে আসার আগে আমাকে অনেক চাকরির গন্ডি পার হতে হয়েছে। আমাকে একজন বলেছিলেন, তুমি যত পড়বে, ততো পরিশীলিত হবে। ভালো ভালো সাহিত্য পড়লে বুঝতে শিখবে। আর সব শেষে তোমার সাহিত্যযাপনে যেন কান্না থাকে…।

অরুণাভ: সেই কান্না ছাপিয়ে আপনার লেখায় এত হাসি…
সঞ্জীব: পৃথিবীতে যখন এসেছিলাম তখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। আর যে শিশু জন্মানোর পর কাঁদে না তাকে নিয়ে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে। তখন তাকে কাঁদানোর জন্য পিঠে চাপড় দেওয়া হয়- একটু কাঁদ বাছা। এক্ষেত্রে তুলসী দাস বলছেন, তুলসী যাব যগ মে আয়ো, তুলসী রোয়ে জাগ হাসে! সবাই তো খুশি ছেলে হয়েছে, ছেলে হয়েছে। কিন্তু তুলসী যগ মে যায়ো, তুলসী হাসে যগ রয়ে। অর্থাৎ তুমি জীবনটাকে এমন করো যাতে সবাই কাঁদে। এই দোঁহাই আমার জীবনে কাজে লেগেছিল। আর চারদিকে তাকাই, তখন যতই গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রের বুলি আওরালেও জগতে একটা কথা আছে Have’s ও Havesn’t. মানে এক শ্রেণীর মানুষ খেয়ে শেষ করতে পারছে না, আর এক শ্রেণীর মানুষ দু’বেলা খেতেই পারছে না। আর যারা খেয়ে শেষ করতে পারছে না, তারাই গণতন্ত্রের মাথায় বসে আছে। তাদের মুখে বড় বড় কথা। এক্ষেত্রে আরও এক কথা বলি। আমি প্রচুর শ্রুতি নাটক করতাম। তুলসী রায় ছিলেন সেসব শ্রূতি নাটকে, এইসব নাটক রবীন্দ্রসদন, মহাজাতি সদন, নিরঞ্জন সদন-সহ বিভিন্ন জায়গায় হত। একদিন নাটক শেষে বললেন, আপনি আজ তেমন হাসাতে পারেননি! রাগান্বিত হয়ে বলে ফেললাম– আজকে আমি হাসাতে আসিনি। কাঁদাতেই চেয়েছি। মোহিত লাল মজুমদারের কবিতা বলতে ইচ্ছে করছে, যত ব্যথা পাই তত গান গাই– গাঁথি যে সুরের মালা! ওগো সুন্দর! নয়নে আমার নীল কাজলের জ্বালা! এই লাইনের মতো সবাই আমাকে বলে বসল– তুমি বাংলা সাহিত্যের চার্লি চ্যাপলিন।

অরুণাভ: আপনি প্রথম জীবনে সন্ন্যাসী হতে চাইলেও জীবন আপনাকে করে তুলল বাংলা সাহিত্যের চার্লি চ্যাপলিন! এখন প্রতিদিনই আপনাকে বিভিন্ন সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এ ছাড়া কলেজ স্ট্রিটের কাছে ঝামাপুকুর লেনে রামকৃষ্ণ সংঘে আপনি নিয়মিত পড়াতে যান। সেই যাপনের কথা কিছু বলুন…
সঞ্জীব: আমি কখনওই ইচ্ছে করে কোনও অনুষ্ঠানে যেতাম না। জোর করে অনেকে নিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আমার জীবনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য উদ্বোধন পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক স্বামী অব্জজানন্দ বলেন সাহিত্যিকদের লেখায় ঠাকুরের কথা লিখে সাধারণ মানুষদের আকৃষ্ট করতে হবে। তারপর দীর্ঘ ষোল বছর সেই পত্রিকাতে ‘পরমপদকমলে’ বিভাগে লিখেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা। যা দিয়ে আমার সারা জীবন ধরে রামকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা। পরে বই হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। শুনেছি সেই বই বেস্টসেলার হয়েছে। আমি সেই বইয়ে রামকৃষ্ণের কথা লিখেছি। তাঁর মুখ দিয়েই তাঁকে কথা বলিয়েছি। যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন’ বইয়েও করেছি। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছি আপনি যেসব বলে গিয়েছেন, এখন জীবন পাল্টেছে; আমরা এখন কী করব? আপনি বলে দিন। আমি ঠাকুরকে মহাঅবতার না করে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। আর আমার এই আঙ্গিকই শ্রোতাদের মাঝে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।