ভারত-পাক উত্তেজনার মাঝে সীমা হায়দারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই হামলার…

Seema haider Love Story

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই হামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করেছে, পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে, ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে এবং অটারি সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) ভিসা ছাড় স্কিম (SVES) বাতিল করা হয়েছে। এই স্কিমের আওতায় ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি নাগরিক সীমা হায়দারের (Seema Haider) ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি কি এই নির্দেশের আওতায় ভারত ছাড়তে বাধ্য হবেন?

   

সীমা হায়দার কে?

সীমা হায়দার একজন পাকিস্তানি নাগরিক, যিনি ২০২৩ সালের মে মাসে তার চার সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের জ্যাকোবাবাদ থেকে করাচি ছেড়ে নেপাল হয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। ৩২ বছর বয়সী এই নারী ২০২৩ সালের জুলাই মাসে উত্তর প্রদেশের গ্রেটার নয়ডার রাবুপুরায় ভারতীয় নাগরিক সচিন মীনার (২৭) সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসেন। সীমা দাবি করেন, তিনি সচিনের সঙ্গে বিয়ে করেছেন এবং হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তারা ২০১৯ সালে একটি অনলাইন গেম খেলার সময় পরিচিত হন। এই বছরের মার্চ মাসে সীমা এবং সচিন একটি কন্যা সন্তানের জনক-জননী হন।

সীমা হায়দারের পাকিস্তানি স্বামী গুলাম হায়দার তাদের সন্তানদের হেফাজতের জন্য ভারতীয় আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সীমা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের অভিযোগে এবং সচিন অবৈধ অভিবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান। সীমার ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন এখনও অনুমোদিত হয়নি, এবং তার আইনি অবস্থান এখনও বিচারাধীন।

সীমা হায়দারের বহিষ্কার নিয়ে জটিলতা

দিল্লি হাইকোর্টের আইনজীবী আবু বকর সাব্বাকের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারত ছাড়তে হবে, যার মধ্যে সীমা হায়দারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। তবে, তিনি জানিয়েছেন যে সীমার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে, যা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। সীমা একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত এবং তাদের একটি সন্তান রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকারের অবস্থান এবং রাজ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সীমার মামলাটি আরও জটিল কারণ তিনি বৈধ ভিসার মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করেননি। তিনি নেপালের মাধ্যমে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, যা স্ট্যান্ডার্ড ইমিগ্রেশন পদ্ধতি লঙ্ঘন করে। তার ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন এখনও বিচারাধীন, এবং তার আইনি অবস্থান স্পষ্ট নয়। সীমার সমর্থকরা যুক্তি দেন যে ভারতে তার বৈবাহিক এবং পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তার প্রতি সহানুভূতি দেখানো উচিত। অন্যদিকে, সমালোচকরা অভিবাসন আইনের কঠোর প্রয়োগের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

জনমত ও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

সামাজিক মাধ্যমে সীমা হায়দারের ভবিষ্যৎ নিয়ে মতভেদ স্পষ্ট। কেউ কেউ মনে করেন, তার বৈবাহিক এবং পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তাকে বহিষ্কার করা হবে না। অন্যরা দাবি করছেন যে সরকারের নতুন নীতি সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা উচিত এবং তার থাকার অনুমতি বাতিল করা উচিত। এক্স-এ পোস্ট অনুসারে, অনেকে সীমার বহিষ্কারের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যেমন “সীমা হায়দারকেও কি পাকিস্তানে ফিরতে হবে?” এবং “তাকে কি এখন ফিরে যাওয়া উচিত?”

সীমা হায়দার বারবার দাবি করেছেন যে তিনি সচিন মীনার সঙ্গে বিয়ে করেছেন এবং হিন্দু রীতি অনুসরণ করছেন। তিনি বিভিন্ন ভিডিওতে হিন্দু ঐতিহ্য পালন করতে দেখা গেছে। তবে, তার নাগরিকত্বের আবেদন অনুমোদিত না হওয়ায় তার ভারতে থাকা আইনগতভাবে বিতর্কিত রয়েছে।

পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষাপট

২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে সংঘটিত জঙ্গি হামলায় ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হন। এই হামলা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরের সবচেয়ে মারাত্মক হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যা পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রক্সি। ভারত সরকার এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছে।

হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) একটি জরুরি বৈঠক করে। বৈঠকে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু জল চুক্তির স্থগিতকরণ, অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ, SAARC ভিসা ছাড় স্কিম বাতিল, পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার, এবং উভয় দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ হ্রাস।

সীমা হায়দারের ভবিষ্যৎ

সীমা হায়দারের মামলা আইনি, রাজনৈতিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জটিল। তিনি SAARC ভিসার আওতায় ভারতে প্রবেশ করেননি, তাই এই নির্দেশ সরাসরি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তবে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তার অবৈধ প্রবেশ এবং আইনি অবস্থান তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। উত্তর প্রদেশ সরকার এবং বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছেছে। সীমা হায়দারের মামলা এই উত্তেজনার মধ্যে একটি মানবিক এবং আইনি দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তার বৈবাহিক সম্পর্ক এবং সন্তানের কারণে অনেকে তার প্রতি সহানুভূতি দেখালেও, অভিবাসন আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবিও উঠছে। সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে, এবং সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সবার নজরে রয়েছে। ভারতের কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে সীমা হায়দারের ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত।

Advertisements