সম্প্রতি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে সংবিধান (১৩০তম সংশোধনী) (130th Amendment Bill) বিল, ২০২৫। এই বিল অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা কোনও নির্বাচিত মন্ত্রী যদি গুরুতর অপরাধমূলক মামলায় গ্রেফতার হয়ে ৩০ দিনের বেশি হেফাজতে থাকেন, তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁরা মন্ত্রীত্ব হারাবেন। প্রথম দর্শনে এটি যেন সংবিধানিক নৈতিকতা রক্ষার জন্য একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও বিরোধীদের মতে, এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে ন্যায়বিচারকে শুধুই এক ধরনের প্রদর্শনীতে নামিয়ে আনা হচ্ছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, এই আইন কার্যকর হলে জনগণের রায়কে অবমূল্যায়ন করা হবে। আদালতের রায় ছাড়াই, শুধুমাত্র ৩০ দিনের আটক থাকার কারণে কোনও মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হবে — যা “দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগে দোষী সাব্যস্ত” করার শামিল। বিরোধীরা আশঙ্কা করছেন, তদন্তকারী সংস্থা বিশেষ করে ইডি (Enforcement Directorate), যাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে, তারা এই আইনের অপব্যবহার করবে।
ভারতের বর্তমান আইনে সাংসদ বা বিধায়করা কেবলমাত্র আদালতের দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের পদ হারান। অথচ এই বিল অনুযায়ী, মন্ত্রীরা বাড়তি কঠোরতার মুখোমুখি হবেন। এর ফলে সাংসদ বা বিধায়ক পদে থাকা ব্যক্তি গুরুতর মামলায় অভিযুক্ত হলেও কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন, কিন্তু মন্ত্রী হলে তাঁকে ৩০ দিনের মধ্যে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের ই.পি. রয়াপ্পা বনাম তামিলনাড়ু (১৯৭৪) মামলার প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপকে অনেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী বলছেন।
রাজ্যসভায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে ইডি মোট ১৯৩টি মামলায় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ২ জন — যা প্রায় ১%। এর মধ্যেও অধিকাংশ মামলা বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। ফলে নতুন এই বিল কার্যকর হলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা প্রবল।
কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য (১৯৭৩) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, সংবিধানের মৌল কাঠামো যেমন আইনশাসন, বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র— এগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। সমালোচকদের মতে, এই বিল সরাসরি সেই কাঠামোর বিরোধিতা করছে। কারণ, বিচার না হয়েও যদি মন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, তবে তা বিচারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর সরাসরি আঘাত।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (ADR)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লোকসভার ৩১% সাংসদ গুরুতর অপরাধমূলক মামলায় অভিযুক্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাসক দলের সদস্য। শুধু তাই নয়, বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অন্তত ২৮ জন মন্ত্রী ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত, যার মধ্যে হত্যাচেষ্টা, মহিলাদের উপর অপরাধ, ডাকাতির মতো অভিযোগও রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে— যদি সত্যিই সংবিধানিক নৈতিকতা রক্ষা করাই উদ্দেশ্য হয়, তবে শাসক দল কেন নিজের মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্বচ্ছতা আনে না?
১৩০তম সংশোধনী বিলের উদ্দেশ্য যদিও শুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা, কিন্তু বাস্তবে এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ তৈরি করতে পারে। গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। কোনও মন্ত্রীর পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে— যেমন অনাস্থা প্রস্তাব বা মন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। বিচার ছাড়াই কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা দেশের সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক সংকেত।