ভারতীয় সেনাবাহিনী বুধবার ভোররাতে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে (পিওকে) জঙ্গি লঞ্চপ্যাডর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor) নামে একটি নির্ভুল সামরিক হামলা পরিচালনা করেছে। এই অভিযানের নামকরণ ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পাবলিক ইনফরমেশন) বা এডিজি পিআই-এর বিবৃতি অনুযায়ী, এই অপারেশনের মাধ্যমে নয়টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে, যা গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও ২৬ জন নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনার প্রতিশ্রুত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কেন এই অভিযানের নাম ‘সিঁদুর’ রাখা হলো? এর পেছনের কারণ ও তাৎপর্য নিয়ে এই প্রতিবেদন।
‘সিঁদুর’ শব্দটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে গভীর তাৎপর্য বহন করে। হিন্দু ঐতিহ্যে সিঁদুর বিবাহিত নারীর সৌভাগ্য ও সম্মানের প্রতীক। এটি রক্তের সঙ্গেও যুক্ত, যা সাহস, ত্যাগ এবং প্রতিশ্রুতির প্রতিনিধিত্ব করে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার প্রতি তাদের অটল প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে। এই নামটি পহেলগাঁও হামলায় নিহত নাগরিকদের রক্তের প্রতিশোধ এবং জাতির সম্মান রক্ষার প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় মা-বোনেদের সিঁদুর মুছে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতেই এই নামকরণ করা হয়েছে
এছাড়া, ‘সিঁদুর’ শব্দটি সিন্ধু নদীর সঙ্গেও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্ত। সিন্ধু নদী ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিকভাবে, এই অঞ্চল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। পহেলগাঁও হামলার পর ভারত ইন্দাস জলচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সিন্ধু নদীর জল বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এই প্রেক্ষাপটে, ‘সিঁদুর’ নামকরণটি সিন্ধু নদীর সঙ্গে যুক্ত ভূ-রাজনৈতিক বার্তাও বহন করতে পারে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, অপারেশনের নামকরণ সাধারণত সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা কৌশলগত তাৎপর্যের ভিত্তিতে করা হয়। ২০১৬ সালের ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ বা ২০১৯ সালের ‘অপারেশন বালাকোট’ এর মতো অভিযানের নামও কৌশলগত বার্তা বহন করেছিল। ‘সিঁদুর’ নামটি শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থানই নয়, বরং জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও কাজ করছে।
এডিজি পিআই-এর এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, “ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জয় হিন্দ!” ভারত জানিয়েছে, এই হামলা কেন্দ্রীভূত, সুনির্দিষ্ট এবং অ-উত্তেজনামূলক ছিল। কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করা হয়নি, যা ভারতের সংযমী নীতির ইঙ্গিত দেয়। তবে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, বাহাওয়ালপুর ও মুজাফফরাবাদে বিস্ফোরণের ঘটনায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যদিও এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
এই অভিযানের নামকরণ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন মত প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, ‘সিঁদুর’ নামটি ভারতের সাংস্কৃতিক শক্তি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে, কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই নামটি পাকিস্তানের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও জটিল করতে পারে, বিশেষ করে ইন্দাস জলচুক্তির প্রেক্ষাপটে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ উভয় দেশকে সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ইসলামাবাদ সফর করে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন।
‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের সামরিক ক্ষমতা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রমাণ। নামকরণের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী জাতির সংহতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তবে এই অভিযানের পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এখন দুই দেশের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে নজর রাখছে।