সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সংসদে পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫-এ (Waqf Amendment Act 2025) স্বাক্ষর করার পর এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে ভারতে শুরু হয়েছে এক তীব্র আইনি লড়াই। এই আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরাসরি আঘাত হানে বলে অভিযোগ তুলে একাধিক মুসলিম নেতা, সংগঠন ও আইনজীবীরা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করেন জামিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের হয়ে সিনিয়র অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বল। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও দুই প্রবীণ আইনজীবী—অভিষেক মনু সিংভি ও আইনজীবী নিজাম পাশা। তাঁরা জানান, এই বিষয়ে একাধিক রিট পিটিশন জমা পড়েছে এবং বিষয়টি জরুরি শুনানির দাবি রাখে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বর্তমান প্রধান বিচারপতি মৌখিকভাবে মামলা উত্থাপন বন্ধ করে লিখিত আর্জি বা ইমেলের মাধ্যমে উল্লেখ করার পদ্ধতি চালু করেছেন। যদিও কপিল সিব্বল জানিয়েছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই চিঠি জমা দিয়েছেন। তখন সিজেআই জানান, তিনি বিকেলে বিষয়টি দেখবেন ও শুনানির তারিখ ঠিক করবেন।
এই আইনের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন কংগ্রেস সাংসদ মোহাম্মদ জাভেদ, এআইএমআইএম সভাপতি আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, আপ বিধায়ক আমানতুল্লাহ খান সহ আরও অনেক নেতা। আসাদুদ্দিন ওয়াইসির আবেদনে আইনটিকে মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক বলে দাবি করা হয়েছে। তাঁর মতে, হিন্দু, জৈন ও শিখ ধর্মীয় দান-সম্পত্তির উপর যেসব সুরক্ষা রয়েছে, তা ওয়াকফের ক্ষেত্রে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
জামিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, “এই বিলটি দেশের সংবিধানের উপর সরাসরি আঘাত। সংবিধান নাগরিকদের সমানাধিকার ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়। এটি একটি বিপজ্জনক চক্রান্ত মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার।”
জামিয়তের সভাপতি মৌলানা আরশাদ মাদানি শুধুমাত্র সংশোধিত আইনের বিভিন্ন ধারা চ্যালেঞ্জ করেননি, বরং একটি অন্তর্বর্তী আবেদনও দায়ের করেছেন, যাতে এই আইন কার্যকর না হয় সেই নির্দেশ দেওয়া যায়। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, রাজ্যস্তরে জামিয়তের ইউনিটগুলো সংশোধিত আইনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টেও মামলা দায়ের করবে।
কেরালার সুন্নি মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন সমস্থ কেরালা জামিয়াথুল উলামাও একটি পৃথক রিট দায়ের করেছে সুপ্রিম কোর্টে। এই সংগঠনের মতে, আইনটি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার অধিকার লঙ্ঘন করছে, যা ভারতীয় সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারায় সুরক্ষিত।
তাঁদের আইনজীবী জুলফিকার আলি পি এস-এর মাধ্যমে দায়ের করা আবেদনে বলা হয়েছে, “এই সংশোধনী আইন ওয়াকফের ধর্মীয় চরিত্র বিকৃত করবে এবং ওয়াকফ বোর্ড ও প্রশাসনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নষ্ট করবে।”
তাঁরা আরও অভিযোগ করেছেন, এই আইন যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ করছে, কারণ এটি রাজ্য সরকারের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে।
একটি এনজিও ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস’ এই আইনকে সংবিধানবিরোধী আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে।
সাংসদ মোহাম্মদ জাভেদের আবেদনে বলা হয়েছে, এই আইন ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় “যৌক্তিহীন সীমাবদ্ধতা” আরোপ করেছে এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের উপর হস্তক্ষেপ করেছে।
ওয়াইসির মতে, এই সংশোধনীগুলি ওয়াকফের সুরক্ষা দুর্বল করে ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে অযথা সুবিধা দেয়, যা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে।
দিল্লির আপ বিধায়ক আমানতুল্লাহ খানের আবেদনে বলা হয়েছে, “এই আইন সংবিধানের ১৪, ১৫, ২১, ২৫, ২৬, ২৯, ৩০ এবং ৩০০-এ ধারার পরিপন্থী।”
সব মিলিয়ে, ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে এক তীব্র রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্ক। একদিকে কেন্দ্রের যুক্তি, এই আইন ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও আধুনিক করবে, অন্যদিকে মুসলিম সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এটি ধর্মীয় অধিকার ও সম্পত্তির উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ।
এই বিতর্কের নিষ্পত্তি এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের উপর নির্ভর করছে। সুপ্রিম কোর্ট কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা শুধু এই আইন নয়, ভবিষ্যতে ধর্মীয় সংস্থার প্রশাসনিক স্বাধীনতার প্রশ্নেও দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে।