ভারত এক নতুন মহাকাশ যাত্রার (Space Mission) দিকে পা বাড়িয়েছে, যেখানে মানুষকে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানোর এবং নিরাপদে ফিরে আসার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ মানব মহাকাশযাত্রা কর্মসূচি তৈরি করা হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি হবে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন) বর্তমানে এই মানব মহাকাশযাত্রার জন্য তৈরি করছে তার সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটের উন্নত সংস্করণ, যা মানব বাহনের পরিবহণের জন্য উপযোগী হবে। এই রকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে গগণযান ক্রু মডিউল, যা মহাকাশে মানব পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
এই মেগা প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান স্থাপনা হল কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে অবস্থিত Vikram Sarabhai Space Centre (VSSC)। এই কেন্দ্রটি ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তির অগ্রভাগে রয়েছে এবং গগণযান প্রকল্পের মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে। VSSC এখন ভারতের মানব মহাকাশযাত্রা কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। এতে রয়েছে এমন একটি ক্রু মডিউল, যা মহাকাশে পৌঁছানোর পর নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সিস্টেম ধারণ করবে।
VSSC-এর ভূমিকা: VSSC, ভারতের মহাকাশ পরিবহণ ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলির উন্নয়নের জন্য দায়ী। ISRO-র সমস্ত রকেট এবং মহাকাশযান VSSC-এ ডিজাইন, উন্নয়ন এবং পরীক্ষিত হয়। ভারতে ISRO-র অন্যান্য সকল মহাকাশ সংক্রান্ত কেন্দ্রের তুলনায় VSSC-তে কর্মী সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখানেই মহাকাশ গবেষণা, উৎক্ষেপণ এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
গগণযান প্রকল্পের জন্য VSSC কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরি করছে, যার মধ্যে রয়েছে Human-Rated Launch Vehicle Mark 3 (HR-LVM3), যা মানব পরিবহণের জন্য উপযুক্ত। এছাড়া তৈরি হচ্ছে Crew Module (যা মহাকাশযাত্রীর জন্য মূল কক্ষ হিসেবে কাজ করবে), Crew Escape System (যা রকেটের কোনো সমস্যা হলে ক্রু মডিউলকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সাহায্য করবে), এবং মহাকাশযানের পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে ধীরে ধীরে গতি কমানোর জন্য ১০টি প্যারাশুটের এক জটিল ব্যবস্থা।
VSSC-এ তৈরি হচ্ছে New Generation Launch Vehicle (NGLV), যার নাম দেওয়া হয়েছে Soorya, যা ভারতীয় মহাকাশ স্টেশন (Bharatiya Antariksh Station) তৈরি করতে ব্যবহৃত হবে। এই রকেটটি আংশিকভাবে পুনঃব্যবহারযোগ্য হবে এবং এর সঙ্গে একটি পুনরুদ্ধারযোগ্য বুস্টার থাকবে। ISRO বর্তমানে বুস্টারের পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসন্ধান করছে, যার মধ্যে রয়েছে ড্রোন ব্যবহার করে নেটের মাধ্যমে বুস্টার ধরে ফেলা।
VSSC-এর ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি: VSSC শুধু গগণযান প্রোগ্রামেই কাজ করছে না, তারা অন্যান্য মহাকাশযানের জন্যও প্রযুক্তি তৈরি করছে। Soorya নামে একটি নতুন রকেটের কাজ চলছে, যা মহাকাশ স্টেশন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হবে। এর জন্য বিশেষ প্রযুক্তি যেমন পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেটের বুস্টার এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি নিশ্চিত করতে কাজ করছে VSSC যে, ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণায় ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে।
গগণযান প্রকল্পের মহতী লক্ষ্য: গগণযান প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো ভারতীয় মহাকাশযাত্রীদের মহাকাশে পাঠানো এবং তাদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আনা। এই প্রকল্পে ISRO বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে মহাকাশযাত্রীদের নিরাপত্তা এবং যাত্রাপথের যে কোনো সম্ভাব্য বিপদের ক্ষেত্রে দ্রুত সুরক্ষা ব্যবস্থা। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহৃত হবে একটি অত্যাধুনিক ক্রু এসকেপ সিস্টেম এবং মহাকাশযানটির উপর রয়েছে নানা ধরনের পরীক্ষা।
VSSC-এর অতীত ও ভবিষ্যৎ: VSSC-র ইতিহাস এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর Satish Dhawan Supercomputing Facility (SDSF) এর আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে এটি এখন দেশের অন্যতম শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার হিসেবে কাজ করছে। এই সুপারকম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে ৪৮৩ ট্রিলিয়ন ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন (TFLOPS) সম্পাদন করতে সক্ষম। এতে ISRO-এর ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানগুলো আরও কার্যকরভাবে পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে।
VSSC-এর মানব মহাকাশযাত্রা কর্মসূচিতে অবদান: বর্তমানে ভারত মহাকাশযাত্রা কর্মসূচি যে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে চলেছে, তার পেছনে মূল অবদান VSSC-র রয়েছে। এখানে প্রশিক্ষিত কর্মী এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে ভারতকে মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। গগণযান প্রোগ্রাম ভারতকে বিশ্বের মহাকাশ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে, এবং দেশের জন্য এক নতুন গৌরবের সূচনা করবে।
ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে Vikram Sarabhai Space Centre এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। গগণযান প্রকল্প এবং অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত শীঘ্রই মহাকাশে মানব অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত হবে। এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, বরং দেশের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায় শুরু হবে, যা ভারতের মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।