ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি প্রত্যাখ্যান বিদেশ সচিবের

ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি (Vikram Misri) গত সোমবার (১৯ মে ২০২৫) সংসদের স্থায়ী কমিটি ফর এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের সামনে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে একটি বিস্তারিত ব্রিফিং…

Foreign Secretary Vikram Misri

ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি (Vikram Misri) গত সোমবার (১৯ মে ২০২৫) সংসদের স্থায়ী কমিটি ফর এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের সামনে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে একটি বিস্তারিত ব্রিফিং প্রদান করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই সংঘাত সম্পূর্ণরূপে প্রচলিত সামরিক ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনও পারমাণবিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের রাজীব শুক্লা ও দীপেন্দর হুদা, এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং বিজেপি সাংসদ অপরাজিতা সারঙ্গি ও অরুণ গোভিল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংসদরা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পহলগাম সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তী ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনা এবং অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনা করা।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি প্রত্যাখ্যান
বিক্রম মিশ্রি বৈঠকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দ্বিপাক্ষিক স্তরে নেওয়া হয়েছে। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বারবার দাবি, যে তাঁর প্রশাসন এই উত্তেজনা প্রশমনে মূল ভূমিকা পালন করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মিশ্রি বলেন, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই বিষয়ে কোনও অনুমতি নেননি।” এই বক্তব্য ভারতের অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করে, যে কাশ্মীর ইস্যুতে কোনও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ভারত গ্রহণ করবে না। ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে দাবি করেছিলেন যে, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের প্রস্তাব এবং হুমকির মাধ্যমে এই যুদ্ধবিরতি অর্জন করেছেন। কিন্তু ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই দাবিকে খারিজ করে বলেন, “ভারত-মার্কিন নেতাদের মধ্যে আলোচনায় বাণিজ্যের কোনও উল্লেখ ছিল না।”

   

পহলগাম হামলার তদন্ত
মিশ্রি প্যানেলকে জানিয়েছেন যে, গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, হামলাকারীরা পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের হ্যান্ডলারদের সঙ্গে হামলার আগে এবং হামলার সময় যোগাযোগ করেছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানে অবাধে কার্যকলাপ চালাচ্ছে এবং প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সিঁদুর শুরু করে, যার মাধ্যমে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা হয় এবং প্রায় ১০০ জন সন্ত্রাসী নিষ্ক্রিয় করা হয়। জৈশ-ই-মোহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈবা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের আস্তানাগুলোও এই অভিযানে ধ্বংস করা হয়েছে।

চীনা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান
কিছু সাংসদ পাকিস্তানের সম্ভাব্য চীনা সামরিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে মিশ্রি এই উদ্বেগকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “এটি কোনও বিষয় নয়, কারণ ভারত পাকিস্তানের বিমান ঘাঁটিগুলোতে কার্যকরভাবে আঘাত হেনেছে।” ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং জানিয়েছেন, রাফিকি, মুরিদ, চাকলালা, রহিম ইয়ার খান, সুক্কুর এবং চুনিয়ানের মতো পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটিগুলোতে নির্ভুল হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলাগুলো পাকিস্তানের সামরিক ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত করেছে।

অপারেশন সিঁদুর এবং দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি
পহলগাম হামলার পর ভারত অপারেশন সিঁদুর শুরু করে, যা পাকিস্তানের সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করার লক্ষ্যে একটি প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযান। এই অভিযানের সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র সামরিক সংঘর্ষ হয়, যার মধ্যে ছিল মিসাইল, ড্রোন এবং বিমান হামলা। তবে ১০ মে উভয় দেশ একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে সম্মত হয়। মিশ্রি জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সামরিক অপারেশনের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজিএমও) ভারতীয় ডিজিএমও-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং উভয় পক্ষ ১৭:০০ ঘণ্টা থেকে সমস্ত সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে, শনিবার রাতে ভারত পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে এবং সামরিক বাহিনীকে যথাযথ জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

Advertisements

আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি
ভারত সরকার পহলগাম হামলার পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি জানাতে ৩৩টি বিশ্ব রাজধানীতে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। এই কৌশল ভারতের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।

এদিকে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি সামাজিক মাধ্যমে তীব্র হয়রানি এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংসদীয় প্যানেল সর্বসম্মতভাবে এই হয়রানির নিন্দা করেছে এবং মিশ্রির পেশাদার আচরণের প্রশংসা করেছে। আইএএস অ্যাসোসিয়েশন এক্স-এ পোস্ট করে বলেছে, “কর্তব্য পালনকারী সিভিল সার্ভেন্টদের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ গভীরভাবে দুঃখজনক।”

বিরোধী দলের প্রশ্ন
বৈঠকে বিরোধী সাংসদরা ট্রাম্পের দাবি ছাড়াও বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের একটি মন্তব্যের সমালোচনা করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে ভারত অপারেশন সিঁদুর শুরুর আগে পাকিস্তানকে জানিয়েছিল। বিদেশ মন্ত্রণালয় এই বক্তব্যকে “তথ্যের ভুল উপস্থাপন” বলে খারিজ করে। একজন বিরোধী সাংসদ পহলগাম হামলার সন্ত্রাসীদের অবস্থান এবং তাদের ধরার জন্য ভারতের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করেন। মিশ্রি জানান, তদন্ত চলছে এবং ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে।

বিক্রম মিশ্রির ব্রিফিং ভারতের দৃঢ় অবস্থানকে তুলে ধরেছে, যে কাশ্মীর একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের নীতি অপরিবর্তিত। ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি প্রত্যাখ্যান এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভারতের সক্রিয় পদক্ষেপ ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক দৃঢ়তার প্রতিফলন। অপারেশন সিঁদুর এবং দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ভারত তার জিরো টলারেন্স নীতি বজায় রেখেছে। সামনে এই উত্তেজনা পুনরায় বাড়তে না পারে, সেজন্য ভারতের কূটনৈতিক এবং সামরিক কৌশল গুরুত্বপূর্ণ হবে।