উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলার একটি গ্রামে এমন একটি মন্দির রয়েছে, যা লোকজনের মধ্যে ‘অভিশপ্ত দেবালয়’ হিসেবে পরিচিত। মন্দিরটি একেবারে ভিন্ন এবং রহস্যময়, কারণ এখানে কেউ শিবলিঙ্গের পুজো করতে সাহস পায় না। এই মন্দিরের নাম ‘এক হাতিয়া দেবাল’। মন্দিরটি নির্মাণের পেছনে দুটি পৃথক কাহিনি রয়েছে, যা আজও লোকমুখে প্রচলিত। তবে, কাহিনির ভিন্নতার কারণে কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না যে আসলে কী ঘটেছিল।
এক সময়ে বালতির গ্রামে একটি প্রতিভাবান শিল্পী বাস করতেন, যিনি পাথর কাটার মাধ্যমে প্রাসাদ, দেবালয়, এবং মূর্তি নির্মাণে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর কাজের খ্যাতি ছিল ব্যাপক, এবং তিনি পাহাড় থেকে পাথর কেটে এনে একাই বিশাল কাঠামো তৈরি করতেন। একদিন একটি দুর্ঘটনায় তাঁর একটি হাত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন। তবে, তাঁর হাল না ছাড়ার মানসিকতা তাঁকে বাধা পেতে দেয়নি। তিনি একটি হাত হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ঠিক সিদ্ধান্ত নেন যে এক হাতে কাজ করবেন, আর পা দিয়ে তাঁর হাতের সহায়তা নেবেন।
এই নতুন উপায়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু শিল্পীর জেদ এবং পরিশ্রম সব বাধাকে পেরিয়ে যায়। একদিন, যখন তিনি গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান, তখন তিনি সেখানে একটি পাথরের খাদানে কাজ শুরু করেন। পরদিন গ্রামবাসীরা সেখানে গিয়ে দেখেন, পাথরের খাদানটি আর নেই, তার বদলে একটি অসাধারণ দেবালয় নির্মিত হয়েছে। তবে, সেই শিল্পী আর কোথাও দেখা দেননি। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারেন যে, শিল্পীর দুঃখের অংশীদার হয়ে দেবতা নিজেই একটি মন্দির বানিয়েছেন।
অন্য একটি কাহিনি মতে, একসময় এই অঞ্চলে একটি শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক রাজা রাজত্ব করতেন। রাজা একদিন এক কারিগরকে দিয়ে সুন্দর একটি স্থাপত্য নির্মাণ করান। কিন্তু যখন কারিগর তার কাজ শেষ করেন, তখন রাগান্বিত হয়ে রাজা সেই কারিগরের একটি হাত কেটে নেন, যাতে ভবিষ্যতে সে অন্য কোথাও স্থাপত্য তৈরি করতে না পারে।
তবে, কারিগরের মনোবল এত শক্তিশালী ছিল যে, তার হাত কাটা গেলেও তার ইচ্ছাশক্তি একটুও দুর্বল হয়নি। প্রতিশোধ নিতে, সেই কারিগর এক রাতে এক হাতে ছেনি ও হাতুড়ি নিয়ে একরাতে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। পরদিন সকালে, গ্রামবাসীরা সেই মন্দিরটি দেখতে পান এবং বুঝতে পারেন যে, সেই কারিগরের প্রতিশোধের ফল এটি। রাজা এবং তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এটি তৈরি হয়েছিল।
এই মন্দিরের সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় হল শিবলিঙ্গটি। স্থানীয় পণ্ডিতরা মন্দিরে প্রবেশ করে দেখেন, শিবলিঙ্গটি বিপরীত দিশায় স্থাপন করা হয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিপরীত দিশার শিবলিঙ্গ খুঁতপূর্ণ এবং তার পুজো করলে মহা অনিষ্ট হতে পারে। এই কারণে এবং পণ্ডিতদের বিধান অনুযায়ী, এই মন্দিরের শিবলিঙ্গের পুজো করা হয় না।
আজও এই মন্দিরের অদ্ভুত গঠন এবং পুজো না হওয়া নিয়ে স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। যদিও মন্দিরটি এক সময় শ্রদ্ধা ও ভক্তির কেন্দ্র ছিল, কিন্তু এর আশ্চর্য নির্মাণ এবং শাস্ত্র বিরোধী অবস্থান লোকজনের মনে ভয় তৈরি করেছে। ফলে, এখানে আজও কেউ শিবের পুজো করতে আসে না এবং মন্দিরটি একটি ‘অভিশপ্ত’ স্থানে পরিণত হয়েছে।
এই মন্দিরের ইতিহাস এবং এর সঙ্গে জড়িত কাহিনিগুলি আজও লোকমুখে শোনা যায়। ‘এক হাতিয়া দেবাল’ বা ‘এক হাতে বানানো দেবালয়’ আজও একটি রহস্য এবং উত্তরাখণ্ডের একটি বিশেষ ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।