উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলায় শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ তুষারধ্বসে (Uttarakhand Avalanche) মৃতের সংখ্যা বেড়ে চারজনে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী শনিবার জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনায় বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন (বিআরও)-এর একটি ক্যাম্পে ৫৫ জন শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন। তুষারধ্বসটি মানা এবং বদ্রীনাথের মাঝামাঝি এলাকায় সকাল ৫:৩০ থেকে ৬:০০-এর মধ্যে আঘাত হানে, যার ফলে আটটি কন্টেনার এবং একটি শেড তুষারের নীচে চাপা পড়ে।
শনিবার সকালে উদ্ধারকারীরা আটকে পড়া শ্রমিকদের খুঁজে বের করতে তৎপরতা শুরু করে। এখন পর্যন্ত ৫০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচজন শ্রমিক এখনও তুষারের নীচে আটকে রয়েছেন। শুক্রবার বৃষ্টি এবং তুষারপাতের কারণে উদ্ধারকাজে বাধা পড়েছিল এবং রাতের বেলা অভিযান স্থগিত করা হয়। শনিবার আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়ায় হেলিকপ্টারগুলো উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছে।
উদ্ধারকাজে তৎপরতা
মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি শনিবার সকালে তুষারধ্বস-বিধ্বস্ত এলাকার একটি আকাশপথে জরিপ করেছেন এবং কর্মকর্তাদের উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ধামির সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন এবং সম্পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। জেলা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অফিসার এন কে জোশি জানিয়েছেন, শনিবার সকালে মানায় অবস্থানরত সেনা এবং ইন্দো-তিব্বতি সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি) কর্মীদের দ্বারা উদ্ধারকাজ পুনরায় শুরু হয়েছে।
উদ্ধার হওয়া ৫০ জনের মধ্যে ১১ জনকে জ্যোতিরমঠের সেনা হাসপাতালে আনা হয়েছে। চামেলি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সন্দীপ তিওয়ারি জানিয়েছেন, এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর, কয়েকজনের হাড় ভেঙেছে এবং বাকিদের সামান্য আঘাত লেগেছে। গুরুতর একজন ছাড়া বাকি সবার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করছেন। তিনি আরও বলেন, “আবহাওয়া আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে, যা উদ্ধারকাজে বাধা দিতে পারে। তবে, সেনার হেলিকপ্টারগুলো উড়ছে এবং আবহাওয়া অনুকূল থাকলে আমরা শীঘ্রই বাকি পাঁচজন শ্রমিককে খুঁজে বের করতে পারব।”
তুষারধ্বসের ঘটনা ও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া
তুষারধ্বসটি মানা গ্রামের কাছে বিআরও-এর একটি ক্যাম্পে আঘাত হানে, যেখানে শ্রমিকরা সড়ক নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এই গ্রামটি বদ্রীনাথ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ভারত-তিব্বত সীমান্তের শেষ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। শুক্রবার সকালে ঘটনার পর থেকে উদ্ধারকারীরা তুষারের নীচে আটকে পড়াদের খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করে। তবে, ভারী তুষারপাত এবং বৃষ্টির কারণে শুক্রবার রাতে অভিযান স্থগিত করতে হয়। শনিবার আবহাওয়া কিছুটা পরিষ্কার হওয়ায় হেলিকপ্টারগুলো উদ্ধারে গতি এনেছে।
মুখ্যমন্ত্রী ধামি এক্স-এ একটি পোস্টে বলেন, “চামেলি জেলার মানার কাছে তুষারধ্বস-বিধ্বস্ত এলাকার আকাশপথে জরিপ করে পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছি। কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি যেন ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।” তিনি আরও জানান, রাজ্য সরকার আটকে পড়া শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছে।
উদ্ধারকাজে চ্যালেঞ্জ
উদ্ধারকাজে জড়িত সেনা, আইটিবিপি, এসডিআরএফ (স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স) এবং এনডিআরএফ (ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স)-এর দলগুলো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছে। শুক্রবারের বৃষ্টি এবং তুষারপাত উদ্ধারকারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। শনিবার সকালে আবহাওয়া কিছুটা পরিষ্কার হওয়ায় সেনার হেলিকপ্টারগুলো উড়তে শুরু করে। তবে, তিওয়ারি জানিয়েছেন, আবহাওয়া আবার খারাপের দিকে যেতে পারে, যা অভিযানে বিলম্ব ঘটাতে পারে।
জ্যোতিরমঠে আনা ১১ জন শ্রমিকের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাঁদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। তিওয়ারি বলেন, “আমরা আশা করছি, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে বাকি শ্রমিকদের শীঘ্রই উদ্ধার করা সম্ভব হবে।” ধামি আহত এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি জ্যোতিরমঠে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন
প্রধানমন্ত্রী মোদি ধামির সঙ্গে ফোনে কথা বলে উদ্ধারকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও ধামির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং দ্রুত উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন। সেনার আইবেক্স ব্রিগেড, আইটিবিপি এবং অন্যান্য সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় উদ্ধারকাজ চলছে।
শ্রমিকদের অবস্থা
উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই বিআরও-এর সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছিলেন। তাদের কন্টেনারে থাকার কারণে অনেকে প্রাথমিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে, তুষারের ভারী চাপ এবং ঠান্ডায় চারজন প্রাণ হারান। জ্যোতিরমঠের সেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই স্থিতিশীল, তবে গুরুতর আহত একজনের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে।
আবহাওয়ার প্রভাব
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে, চামেলি, রুদ্রপ্রয়াগ এবং অন্যান্য পার্বত্য জেলায় শুক্রবার পর্যন্ত ভারী তুষারপাতের পূর্বাভাস ছিল। শনিবার সকালে আবহাওয়া কিছুটা পরিষ্কার হলেও, আবার খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতি উদ্ধারকাজে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তুষারপাতের কারণে বদ্রীনাথ-জ্যোতিরমঠ মহাসড়ক বন্ধ রয়েছে, যা স্থলপথে উদ্ধারকারীদের পৌঁছানো কঠিন করে তুলেছে।
এই ঘটনা দেশজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ধামি বলেন, “আমরা সবাইকে নিরাপদে উদ্ধার করার জন্য কাজ করছি। জেলা প্রশাসন, সেনা এবং আইটিবিপি একযোগে কাজ করছে।” শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রিয়জনদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করছেন। স্থানীয়রাও তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।
এই তুষারধ্বস উত্তরাখণ্ডের পার্বত্য এলাকার জন্য একটি বড় সতর্কতা। আবহাওয়া এবং উদ্ধারকারীদের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে এখন পাঁচজন আটকে পড়া শ্রমিকের ভাগ্য। দেশবাসী তাদের নিরাপদে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে।