ভারতে নারী স্বাধীনতা (Women Independence)ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নে গভীর বৈষম্য এখনও বিদ্যমান, এবং এই বৈষম্যের প্রকৃতি রাজ্যভেদে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডে গ্রস ডোমেস্টিক বিহেভিয়র (জিডিবি) সার্ভে ২০২৫-এর প্রথম সংস্করণে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ৯,০০০-এরও বেশি উত্তরদাতার মতামতের ভিত্তিতে তৈরি এই জরিপে ‘জেন্ডার অ্যাটিটিউড’ বা লিঙ্গভিত্তিক মনোভাব নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, নারীরা নিজেদের উপার্জন নিজেরা পরিচালনা করার অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই জরিপে দেখা গেছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারী স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক লিঙ্গ সমতার পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
সমীক্ষার মূল তথ্য: প্রগতি ও পিতৃতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত
ইন্ডিয়া টুডে-র এই অগ্রণী জরিপটি ভারতের ২১টি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৯৮টি জেলা জুড়ে পরিচালিত হয়েছে। সমীক্ষাতে মোট ৯,১৮৮ জন উত্তরদাতা অংশ নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৪.৪% শহরাঞ্চল এবং ৪৫.৬% গ্রামীণ এলাকা থেকে এসেছেন। এই সমীক্ষাতে চারটি প্রধান বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে: নাগরিক আচরণ, জননিরাপত্তা, লিঙ্গভিত্তিক মনোভাব এবং বৈচিত্র্য ও বৈষম্য। তবে ‘জেন্ডার অ্যাটিটিউড’ বিভাগটি বিশেষভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, কারণ এটি ভারতের নারীদের গৃহস্থালি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গভীর বৈষম্য প্রকাশ করেছে।
এই সমীক্ষাটিতে দেখা গেছে, ভারত একদিকে যেমন শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি গৃহস্থালির সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এখনও শক্তভাবে বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, ৬৯% উত্তরদাতা মনে করেন যে গৃহস্থালির বড় সিদ্ধান্তে পুরুষদেরই চূড়ান্ত কথা বলা উচিত। এই মনোভাব বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আরও বেশি প্রকট, যেখানে ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ ভূমিকার প্রতি সমর্থন বেশি দেখা গেছে।
কেরলের শ্রেষ্ঠত্ব, উত্তরপ্রদেশের পিছিয়ে পড়া
জরিপের ফলাফলে লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে কেরল শীর্ষে রয়েছে। কেরলের ৯১% উত্তরদাতা মনে করেন, নারীদের নিজেদের উপার্জনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এই রাজ্যে নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হারও জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে, বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ এই তালিকায় সর্বনিম্ন স্থানে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশে ৯৬% উত্তরদাতা বলেছেন, গৃহস্থালির বড় সিদ্ধান্তে পুরুষদেরই আধিপত্য থাকা উচিত। এই রাজ্যে নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পারিবারিক অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম দশে স্থান
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে প্রথম দশে স্থান করে নিয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই রাজ্যে নারীদের নিজেদের উপার্জন পরিচালনার অধিকার নিয়ে তুলনামূলকভাবে উদার মনোভাব রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ৬৮% উত্তরদাতা মনে করেন, নারীদের তাদের আয়ের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য অনেক রাজ্যের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। তবে, এখানেও নারী নিরাপত্তা ও গার্হস্থ্য হিংসার মতো সমস্যা পুরোপুরি দূর হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন ‘কন্যাশ্রী’ এবং ‘রূপশ্রী’, নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রকল্পগুলি নারীদের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার পথে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওড়িশার মতো আরেকটি রাজ্যে মাত্র ২৭% উত্তরদাতা নারীদের আর্থিক স্বাধীনতার পক্ষে মত দিয়েছেন, যা এই বিষয়ে আঞ্চলিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে। সমীক্ষাটিতে আরও দেখা গেছে, উত্তরপ্রদেশে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের হারও সর্বোচ্চ, যা জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই পরিস্থিতি নারী নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দুর্বলতা প্রকাশ করে।
নারী নিরাপত্তা ও সামাজিক মনোভাব
সমীক্ষাটিতে জননিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। ৪২% উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় নারীদের প্রতি উত্ত্যক্তকরণ বা হয়রানি (ইভ টিজিং) একটি নিয়মিত সমস্যা। এই পরিসংখ্যানে আঞ্চলিক ভিন্নতা লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুতে মাত্র ১৭% উত্তরদাতা এই সমস্যার কথা বলেছেন, কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য কর্নাটকে এই সংখ্যা ৭৯%। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে, এই ধরনের ঘটনার প্রকোপ বেশি বলে জরিপে উঠে এসেছে।
এই তথ্যগুলি ইঙ্গিত করে যে নারী স্বাধীনতা শুধু আর্থিক বা শিক্ষাগত ক্ষমতায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিরাপত্তা ও সামাজিক মনোভাবের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিজেপির নীতি ও সমালোচনা
বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ও রাজ্যে নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে, যেমন ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ এবং তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ আইন। এই পদক্ষেপগুলি নারী ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হলেও, সমালোচকরা বলছেন যে এই নীতিগুলি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনও সীমিত। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে নারী শিক্ষার হার এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম, যা সরকারি নীতির বাস্তবায়নে ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, বিজেপির সমর্থকরা দাবি করেন যে হরিয়ানার মতো রাজ্যে ‘বেটি বাঁচাও’ প্রকল্পের মাধ্যমে লিঙ্গানুপাত উন্নত হয়েছে। তবে জরিপের ফলাফল এই দাবির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কারণ লিঙ্গ সমতার বৃহত্তর সূচকগুলিতে এই রাজ্যগুলি এখনও পিছিয়ে রয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডে-র জিডিবি সমীক্ষা ভারতের লিঙ্গভিত্তিক মনোভাবের একটি জটিল চিত্র তুলে ধরেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারী স্বাধীনতা পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে নিরাপত্তার অভাব, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সুযোগের সীমাবদ্ধতা এবং পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এই সমস্যা কেবল বিজেপি শাসিত রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সর্বভারতীয় চ্যালেঞ্জ।
নারী স্বাধীনতার পথে অগ্রগতির জন্য শিক্ষার প্রসার, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। কেরলের মতো রাজ্য যেমন একটি ইতিবাচক উদাহরণ স্থাপন করেছে, তেমনি উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলির উন্নতির জন্য আরও বেশি প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই জরিপ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নারী ক্ষমতায়নের জন্য কেবল নীতি প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, তার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।