আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক(Tariffs) সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ফের সরগরম আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল।
প্রাক্তন জি-২০ শেরপা ও নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত এদিন (বুধবার) সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে ভারতের কাছে একটি “ওয়েক-আপ কল” বা সতর্কবার্তা বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন করে ভারতীয় রপ্তানির উপর শুল্ক চাপাচ্ছে, তা কেবল রাশিয়ার তেল আমদানির প্রশ্ন নয়—এর আড়ালে রয়েছে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা।
অমিতাভ কান্ত তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভারতকে এখনই সাহসী ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। কারণ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র বাণিজ্য বা আমদানি–রপ্তানির অঙ্কের হিসেব নয়, বরং রাজনৈতিক অবস্থান, কৌশলগত সম্পর্ক এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক স্থিতি গড়ে তোলাই আসল।
ট্রাম্পের শুল্ক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট
ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শনে আমেরিকা–কেন্দ্রিক অর্থনীতি (“America First”) সর্বাগ্রে থাকে। সেই কারণে, প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন একাধিকবার ভারত, চীন এবং অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিলেন তিনি। এবারও তাঁর বার্তা একই—বিদেশি পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক চাপানো হবে, যাতে মার্কিন শিল্প ও শ্রমিকরা সুরক্ষা পায়।
কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত যে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বিষয় নয়, তা স্পষ্ট করে দিলেন কান্ত। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সস্তা তেলের বিকল্প সরবরাহ নিয়ে সরাসরি আপত্তি জানাতে না পারলেও, ভারতকে চাপ দেওয়ার অন্য পথ বেছে নিয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে শুল্ক।
ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ
ভারত গত কয়েক বছর ধরে রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল আমদানি করে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওঠানামার ধাক্কা কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির চাপও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার এই শুল্ক আরোপের ফলে শুধু ভারতীয় রপ্তানি শিল্পই সমস্যায় পড়বে না, বরং ভারতের স্বাধীন জ্বালানি কৌশলের উপরও চাপ সৃষ্টি হবে।
অমিতাভ কান্ত সতর্ক করে বলেছেন, এখন ভারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত করা। এর জন্য শিল্পক্ষেত্রে নতুন সংস্কার, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ, এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে (supply chain) ভারতকে অপরিহার্য করে তোলা জরুরি।
সাহসী সংস্কারের ডাক
ভারতের উন্নয়নের জন্য অমিতাভ কান্ত বারবার বলেছেন—“Incremental reforms will not work, India needs big-bang reforms.” এবারও তাঁর বার্তা একই। শুধু ক্ষুদ্র পরিবর্তন বা ধাপে ধাপে সংশোধন নয়, বরং কৃষি, শিল্প, প্রযুক্তি, জ্বালানি এবং রপ্তানি ক্ষেত্রে একেবারে বৃহৎ ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষ করে জ্বালানি ক্ষেত্রে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ হাইড্রোজেন, বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং আধুনিক পরিকাঠামো তৈরি করতে সরকার ও বেসরকারি উভয় স্তরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানির বাজার বৈচিত্র্যময় করা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার মতো নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন
কান্তের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে ভারতের “Strategic Autonomy” রক্ষার প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত সর্বদা নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে স্বতন্ত্র রেখেছে। বর্তমানে ভূরাজনীতির টানাপড়েনে আমেরিকা-রাশিয়া-চীন—তিন শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মার্কিন শুল্ক সেই চ্যালেঞ্জকেই আরও জটিল করে তুলছে।