বাঘ মামা, দেয় না হামা। গায়ে তার নেই জামা। তার হুংকার আছে, থাবা আছে। যাতে অনেকেরই প্রাণ গিয়েছে। সেই বাঘের সংখ্যা ভারতে কমে (India Tiger Population) আসছিল। সেই ছবিটা বদলেছে। তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের বাঘের সংখ্যা গত দুই দশকে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশবাদীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে যেখানে ভারতের বাঘের সংখ্যা ছিল মাত্র ১,৪১১টি, সেখানে ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৬৮২টিতে, যা ১৬১% বৃদ্ধির পরিচয় দেয়। এই অসাধারণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সরকারি প্রকল্প “প্রজেক্ট টাইগার” এবং জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (NTCA)-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টা।
বাঘ সংরক্ষণে রাজ্যগুলোর ভূমিকা
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বিভিন্ন। মধ্যপ্রদেশে বাঘের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৭৮৫-এ পৌঁছেছে, যা ১৬২% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। কেরালায় এই হার আরও উল্লেখযোগ্য, যেখানে ৪৬টি থেকে ২১৩টি বাঘের উত্থান ঘটেছে, অর্থাৎ ৩৬৩% বৃদ্ধি। মহারাষ্ট্রে ১০৩টি থেকে ৪৪৪টি বাঘের বৃদ্ধি (৩৩১%) এবং উত্তরাখণ্ডে ১৭৮ থেকে ৫৬০টি (২১৫%) বাঘের বৃদ্ধি রেকর্ড করা গেছে। তামিলনাড়ুতে ৭৬ থেকে ৩০৬টি (৩০৩%) এবং আসামে ৭০ থেকে ২২৯টি (২২৭%) বাঘের উন্নতি দেখা গেছে। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘ সংরক্ষণে সফলতা অর্জন করা হয়েছে। তবে আন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানায় একটি ব্যতিক্রমী হ্রাস (৯৫ থেকে ৮৪, অর্থাৎ -১২%) লক্ষ্য করা গেছে, যা বাস্তুতন্ত্রের অংশবিক ভাঙন এবং মানুষের বসতির প্রভাবের কারণে ঘটেছে।
প্রজেক্ট টাইগারের সাফল্যের রহস্য
১৯৭৩ সালে শুরু হওয়া “প্রজেক্ট টাইগার” একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বাঘের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পশুহত্যা প্রতিরোধে কেন্দ্রীভূত। জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (NTCA) এই প্রকল্পের পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র (Science জার্নালে) এই সাফল্যের পেছনের কারণগুলো উল্লেখ করে। পশুহত্যা প্রতিরোধ, শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় শিকারী প্রাণীদের সংখ্যা বৃদ্ধি, এবং মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত কমানোর মাধ্যমে এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। গবেষক যদুবেন্দ্রদেব জালা, যিনি ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির একজন প্রধান বিজ্ঞানী, বলেছেন যে, উচ্চ মানুষের জনসংখ্যার অঞ্চলে বাঘের বৃদ্ধি সম্ভব নয়—এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নতি
বাঘ সংরক্ষণের সাথে সাথে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় উন্নতি আনার কাজও চলছে। বাঘ সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোতে ইকোট্যুরিজমের বিকাশ ঘটেছে, যা স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। ট্যুরিস্টদের আগমন এবং এর ফলে আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য আরও বিনিয়োগের পথ তৈরি করছে। তবে, এই সাফল্যের মধ্যেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় এবং মানুষের বসতি প্রসারণ বাঘ সংরক্ষণের জন্য ভবিষ্যতে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সুন্দরবনের মতো অঞ্চলে সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি এবং লবণাক্ত পানির প্রভাব বাঘের জন্য শুষ্ক জল ও বাসস্থানের সংকট সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
ভারত আজ বিশ্বের বাঘ জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% ভরণপোষণ করছে, এবং এই সাফল্যকে অন্যান্য বাঘ-প্রজাতির দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব কমানো, বন উজোড় করা রোধ, এবং মানুষ-বাঘ সংঘাত কমানোর উপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সরকারের পক্ষে নতুন বাঘ সংরক্ষণ অঞ্চল তৈরি এবং বিদ্যমান অঞ্চলগুলোর সংরক্ষণে আরও তীব্র পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এই উন্নতির মাধ্যমে ভারত বিশ্বায়নের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে। তবে, এই সাফল্যকে ধরে রাখতে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। ভারতের বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে বাঘ—এই দেশের গর্বের প্রতীক, তাদের রক্ষায় আমাদের সকলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।