গুয়াহাটি, ৩০ অক্টোবর: বলে— “আলো যত উজ্জ্বল, ছায়া তত গাঢ়।”
২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর, দীপাবলির সেই উজ্জ্বল দিনটি আসামের (Assam) ইতিহাসে পরিণত হয়েছিল এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়ে। উৎসবের আকাশে যখন আতশবাজির ঝলকানি, তখনই অচিন্তনীয় নিষ্ঠুরতায় গর্জে উঠেছিল মৃত্যুর বিস্ফোরণ।
মুহূর্তের মধ্যে আনন্দের আলো নিভে গিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল রক্ত আর ধোঁয়ায়। সেদিন দুপুরবেলা ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছিল যেন। গুয়াহাটির ব্যস্ততম গণেশগুড়ি, পাণবাজার, ফান্সিবাজার, বরপেটা রোড, কোকরাঝাড় ও বঙাইগাঁও— সব একসঙ্গে কেঁপে উঠেছিল ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণে। চারদিক ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল; মাটি জুড়ে ছড়িয়ে ছিল রক্ত, ভাঙা কাচ আর মানুষের চিৎকার।
সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮১ জন নিরীহ মানুষ, আহত হয়েছিলেন ৪৭০ জনেরও বেশি। সেই দিনটি ছিল যেন আসামের বুক চিরে লেখা এক রক্তাক্ত ইতিহাস। দীপাবলির উৎসব আর শোকের দিনে তফাৎ ছিল না। সেদিন যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, কেউ ফিরে আসেননি। যে শহর হাসছিল, সেই শহর মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষ বোঝে উঠতে পারেনি— উৎসবের আলো কখন যে মৃত্যুতে রূপ নিল।
তদন্তে প্রকাশ পায়, এই হত্যালীলার মূলচক্রী ছিলেন বড়ো জঙ্গি সংগঠন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বডোল্যান্ড (এনডিএফবি)-এর নেতা রঞ্জন দাইমারি। এক দশকব্যাপী তদন্ত শেষে ২০১৮ সালে বিশেষ আদালত রঞ্জন দাইমারিসহ ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। সিবিআই এই মামলায় দুটি চার্জশিট দাখিল করেছিল, যাতে ২২ জনের নাম ছিল। পরবর্তীতে গৌহাটি উচ্চ ন্যায়ালয় রঞ্জন দইমারির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে।
আদালতের রায়ে ন্যায়বিচারের এক আভাস এলেও, নিহতদের পরিবারের চোখের জল এখনও শুকোয়নি। কেউ হারিয়েছেন মায়ের কোলে সন্তান, কেউ সন্তানের চোখের সামনে হারিয়েছেন বাবা, কেউ আবার নিজের শরীরের অঙ্গ হারিয়ে আজও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের জীবনে ৩০ অক্টোবর মানে— এক দিন, যা ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়, বুকের ভেতর দগদগে ক্ষত হয়ে আছে।
প্রতি বছর এই দিনটি অসমবাসীর মনে জাগিয়ে তোলে অতীতের আতঙ্ক। গুয়াহাটির গণেশগুড়ি চত্বর ভরে ওঠে মোমবাতির আলোয়, কিন্তু সে আলো আনন্দের নয়, সে আলো বেদনার। মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে নীরবে, কেউ মন্ত্র পড়ে, কেউ প্রার্থনা করে— যেন আর কোনো মা সন্তান হারিয়ে পাথর না হয়ে যায়, যেন আর কোনো ঘর দীপাবলির আগেই অন্ধকারে না ডুবে যায়।
তখনকার সরকার ও প্রশাসনের ওপর উঠেছিল তীব্র ক্ষোভ। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “এমন নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে সম্ভব?” তদন্তের পর জানা যায়, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত বোমাগুলি ছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আরডিএক্স, যেগুলি একাধিক স্থানে একযোগে বিস্ফোরিত হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা এত নিখুঁত ছিল যে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি হতবাক হয়ে যায়। পরে জানা যায়, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যের শান্তি ও একতাকে ধ্বংস করা।
বলে— “রক্তে লেখা ইতিহাস কখনও মুছে যায় না।” সেই দিনটি তাই আজও ইতিহাসের পাতায় রক্তের দাগ হয়ে রয়ে গেছে। শুধু গুবাহাটি নয়, সারা আসাম আজও স্মরণ করে সেই কালো দুপুরকে। বহু পরিবার আজও ভয় পায় আতশবাজির শব্দে, কারণ সেই শব্দে ফিরে আসে বিস্ফোরণের স্মৃতি।
১৭ বছর কেটে গেলেও ক্ষত আজও শুকায়নি। দীপাবলির আলোয় যখন অন্য ঘর সাজে আনন্দে, তখন কোনো এক অন্ধকার ঘরে আজও জ্বলে থাকে একটি প্রদীপ— হারানো জীবনের স্মৃতিতে। সেই প্রদীপ যেন প্রার্থনা করে, শান্তির জন্য, ন্যায়ের জন্য, ভালোবাসার জন্য।
আর এই দিনে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর অসমের ইতিহাসে এক কালো দিন। সন্ত্রাসবাদীদের নিষ্ঠুরতায় বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন। অকালপ্রয়াত প্রতিটি আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা, এবং আহতদের পরিবারবর্গের প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা।”
রাজনৈতিক মহলেও এই দিনটি ঘিরে শোকপ্রকাশ অব্যাহত। অনেক বিশ্লেষক বলেন, এই ঘটনার পরই রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও ৩০ অক্টোবর আজও এক সতর্কতার প্রতীক— সহিংসতার বিরুদ্ধে মানবতার প্রতিবাদের দিন।
অসমের সাধারণ মানুষ বলেন, “জ্বালার আগুনে আলো নেই, শুধু ছাই।” ২০০৮ সালের সেই বিস্ফোরণ তাই আজও শেখায়, অস্ত্র নয়, আলো নয়, কেবল শান্তিই বাঁচাতে পারে মানুষকে। সেদিনের নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতি বছর গণেশগুড়ি চত্বরে জ্বলে ওঠে শোকের প্রদীপ। বেদনার সেই আলো যেন নীরবে বলে যায়, “অন্ধকার যতই গভীর হোক, একদিন না একদিন আলো আসবেই।”



