সালটা ১৯৮৭। ঘন সবুজ দেবদারু, পাইনের বন চিড়ে স্নিগ্ধ-শীতল হাওয়া বয়, কিন্তু বিষাদের। ঝিলাম, রাভির স্রোতও যেন প্রাণহীন। লালচকে গুটিকয়েক খদ্দের-দোকানি নিজেদের ছায়াকেও ভয় পায়। ‘কাশ্মীর’ আর ‘সন্ত্রাস’ যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। নব্বইয়ের দশক, যখন উপত্যকায় ‘সন্ত্রাস’ মানে ‘বিদ্রোহ’ আর সন্ত্রাসবাদীদের ‘মিশন’ মানে ‘জং-এ-আজাদি’ (স্বাধীনতার লড়াই)। সেই সময়ই ভূস্বর্গের ১৮ বছরের এক সাধারণ ছেলে সৈফুল্লা ফারুক, যে কিনা মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের পোলিং এজেন্ট ছিল, নিজের পছন্দের ‘সরকার’ চেয়েছিল, কিভাবে ‘সন্ত্রাসবাদী’-তে পরিণত হয়েছিল, সেই ঘটনাই সাম্প্রতিক সামনে উঠে এসেছে।
নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ফারুকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ‘জিতছে’। কিন্তু হঠাৎ ঘোষণা হল, হেরে গেছে! যে দলের পোলিং এজেন্ট ছিল ফারুক, সেটিকে সমর্থন করত জমাত-এ-ইসলামি। যাদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আবেগ পাকিস্তানের প্রতি অধিক ছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরদিন সন্ধ্যাবেলায় নিজের ঘরেই ছিল ফারুক। আচমকা পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর ওপর শুরু করল ‘অত্যাচার’। বেশ কয়েকমাস জেলে কাটিয়ে ঘরে ফিরে কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করল যে তাঁরা পাকিস্তান যাবে। সেখান থেকে বোমা-বারুদ নিয়ে এসে ‘আজাদি’-র যুদ্ধে নামবে।
ফারুক বলেন, “একজন গাইডের সঙ্গে ৬ রাত হাঁটার পর পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছই। ভারতীয় সেনার নজর ঘুরিয়ে সেই সুযোগে আমাদের বর্ডার পার করানই ছিল আসল লক্ষ। পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে কয়েকজন পাক-সেনা এসে আমাদেরকে কাছের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। দুইদিন বিশ্রামের পর শুরু হয় ক্লাস।”
কিভাবে হত ট্রেনিং?
উত্তরে ফারুক বলেন, ‘জিহাদ’ নিয়ে কথা হত। কিভাবে কাশ্মীরিদের উপর দিনদিন অত্যাচার বাড়ছে, আমাদের মা-বোনেদের কিভাবে সম্মানহানি হচ্ছে, ‘কাশ্মীরিয়ত’ সংকটে এসব বলা হত। শুনে রক্ত গরম হয়ে যেত। তৃতীয় দিনের ক্লাসে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আমাদের কি এই অত্যাচার সহ্য করা উচিৎ?” এই প্রশ্নের উত্তর তখন সকলের মস্তিষ্কে পরিস্কার। তারপর শুরু হত হাতিয়ারের ট্রেনিং। প্রতিদিন নতুন নতুন অস্ত্র চালনার ট্রেনিং দেওয়া হত।
কাশ্মীর ফিরে কি হল?
পাকিস্তানে ট্রেনিং নিয়ে ফেরার পর কাশ্মীরে নিজেকে ‘রকস্টার’ মনে হত। কাঁধে কার্তুজের পেটি, হাঁটে রিভলবার আর বুকে অদম্য সাহস। যেখানেই যেতাম, বহুমূল্যবান জিনিসও জলের দরে দিয়ে দিত। সময় বদলালো। আমরা সন্ত্রাসবাদী ছিলাম। ধীরে ধীরে ঘরবাড়ি, আত্মীয় পরিজন সব হারালাম। জেল খাটলাম। তারপর বোধ হল, যে মায়ের দুধ খেয়ে বড় হলাম, এক ভুলে সেই মাকেই রক্তাক্ত করে দিচ্ছি। “আসলে ক্ষমতা খুব সাংঘাতিক জিনিস। কোথায় আমি কাশ্মীরে এক সাধারণ পোলিং এজেন্ট ছিলাম আর কোথায় পরে আমি পুরো এলেকার হিরো হয়ে গেছিলাম।”
ফারুক জানাচ্ছেন, ১৯৯১ এ সমগ্র উপত্যকায় ‘আজাদি’-র ধ্বনি উঠত। সোপিয়ানকে যেখানে কাশ্মীরের ‘আপেলের ঝুড়ি’ বলা হয়, সেখানে গাছে ফল না ধরলেও এলাকার প্রত্যেক গলিতে একজন করে সন্ত্রাসবাদী তৈরি হত। চারিদিকে বন্দুকের এত দাপট ছিল যে সাধারণ মানুষও প্রলোভনের শিকার হত। তবে পাকিস্তানের জঙ্গি ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে আসার পরেও কোনও সন্ত্রাসী হামলার অংশ হননি বলে দাবী করেছেন ফারুক।
ঘরে ফেরা
“নিজের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে যদি মায়ের আঘাত লাগে তাহলে কি সেই মা সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়? বরং তাকে ক্ষমা করে নিজের বুকে টেনে নেয়। এই দেশ আমার মা। আমি তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেছি। শাস্তি হিসেবে জেল খেটেছি। আমার মা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।” জীবনের ইতিহাসের খাতার সেই রক্তাক্ত, বিভীষিকাময় অধ্যায়ের কাহিনী শেষ করতে করতে ফারুক বলেন, “মাঝে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তো আমি নিজে জঙ্গি এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলি”। বর্তমানে ছোটখাটো ঠিকেদারির কাজ করে ‘প্রাক্তন জঙ্গি’ ফারুক সৈফুল্লা।