‘মাফলারম্যান’ কেজরীর উত্থান-পতন: প্রতিশ্রুতি ছাপিয়ে রাজনীতির কাহিনী

নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনীতির খেলা নয়, একটি গভীর আবেগের বিষয়ও বটে। ভোটকেন্দ্রে একা দাঁড়িয়ে যখন একজন ভোটার ইভিএম-এর বোতাম চাপেন, তখন তাঁর মন থেকে যা বেরিয়ে…

The Unravelling of the Mufflerman

নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনীতির খেলা নয়, একটি গভীর আবেগের বিষয়ও বটে। ভোটকেন্দ্রে একা দাঁড়িয়ে যখন একজন ভোটার ইভিএম-এর বোতাম চাপেন, তখন তাঁর মন থেকে যা বেরিয়ে আসে, তা আসলে তাঁর আবেগ। এই আবেগের শক্তিতেই অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং তাঁর আম আদমি পার্টি (আপ)-এর অভাবনীয় উত্থান ঘটেছিল। মাফলারম্যান কেজরীওয়াল ঝাড়ু হাতে এলেন, এক নতুন রাজনীতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে—দিল্লির সাধারণ মানুষের জন্য সবকিছু পরিষ্কার করবেন। এ ছিল শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটি ছিল এক মহান আশার প্রতীক, যা জনগণ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিল।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই প্রতিশ্রুতি ও আবেগ রাজনীতির কঠিন বাস্তবতার সামনে হার মানে। একসময় যে কেজরীওয়াল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন, সেই তিনিই রাজনীতির স্রোতে গা ভাসালেন। রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের স্বার্থ—অথচ শেষ পর্যন্ত সেই রাজনীতি রাজনীতিরই এক রূপ হয়ে উঠল৷

   

২০১১ সালে আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে জন্ম নিয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ সই সময় এই দলই হয়ে উঠেছিল বিকল্প৷ দিল্লির বুকে ঠিক যেন  নতুন সূর্যের আলো। কেজরীওয়াল, এক হাফহাতা শার্ট এবং স্যান্ডেল পরা এক সাধারণ মানুষ, তৈরি করেছিলেন একটি নতুন প্রতিমূর্তি—যা ছিল রাজনীতির চিরাচরিত ছবি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বলপয়েন্ট পেন তাঁর পকেটে, যে পেনটি এক শিক্ষিত এবং দেশপ্রেমী কর্মীর প্রতীক, সেই কমলের মাধ্যমেই কেজরীওয়াল প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি সিস্টেম পরিষ্কার করার জন্য প্রস্তুত।

২০১৩ সালে গঠিত হয় আপ৷ ২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভায় ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৩টি আসন জিতে সরকার গঠন করে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। দিল্লির জনগণ তাঁর মধ্যে যে পরিবর্তনের আশ্বাস পেয়েছিল, তা শুধু দিল্লি নয়, বরং সারা ভারতের মানুষ অনুভব করেছিল। 

তামাম দুনিয়ায় সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল কেজরীওয়াল ও আপ এর উপর।  ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে লোকসভায় বিপুল ভোটে জয় লাভ করে বিজেপি৷ সেই সময়ও স্যান্ডে পায়ে কেজরীওয়ালের সেই প্রতীক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কেজরীওয়াল কর মুক্ত জল, বিদ্যুৎ, উন্নত সরকারি স্কুল, এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও, চাপ বাড়তে থাকে মধ্যবিত্তের পকেটে। বহু পরিবারের বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যায়৷ পকেট ফাঁকা হয় ‘আমআদমির’৷ বেড়ে যায় জলের বিল৷ 

এদিকে, কেজরীওয়াল রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে ক্রমেই জাতীয় রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করে৷ যা তাঁকে দিল্লির রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে ঠেলে দেয়। যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণ, কুমার বিশ্বাস এবং আশুতোষের মতো বহু আপ নেতা দলীয় বিরোধের কারণে সরে যান। এই সময়েই আপ কেজরীওয়াল এবং তাঁর অনুগামীদের নেতৃত্বের দল হয়ে ওঠে, যেখানে দলের আদর্শ নষ্ট হয়ে যায়।

২০২০ সালে, কেজরী ও তাঁর দলকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয় দিল্লি৷ কিন্তু সেই সময় থেকেই কেজরীওয়াল ও আপ’এর জাতীয় রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ সমীকরণ স্পষ্ট হতে শুরু করে। ২০২২ সালে আপ পাঞ্জাবে সরকার গঠন করে জাতীয় দলের মর্যাদা লাভ করে৷ তবে, গোয়া, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, এবং হরিয়ানায় কোনও দাগ কাটতে পারেনি আপ।

তারপর আসে ২০২২ সালে দিল্লির আবগারি কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে৷ অভিযোগ ওঠে ,আপ দিল্লির মদ ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করেছে। এই অভিযোগের ফলে কেজরীওয়ালের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনগণের কাছে তাঁর স্বচ্ছ্বতা হারায়৷

এদিকে, কেজরীওয়াল একসময় দিল্লির বায়ু দূষণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৬৬% দূষণ কমানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সেই প্রতিশ্রুতি উধাও হয়ে যায়, যখন দিল্লির আকাশ আরো বেশি মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের কৃষি আগুনকে দায়ী করেছিলেন, তারপর পাঞ্জাবের পর বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানা সরকারের ওপর দায় চাপাতে শুরু করেন।

কেজরীওয়াল, যিনি একসময় সিস্টেম পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছিলেন, এখন সেই পরিবর্তনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কথা আর কাজের মধ্যে ফারাক স্পষ্ট হয়েছে, এবং তিনি নিজেই নিজের সোনালি দিক হারিয়ে ফেলেছেন। আপ’এর প্রতিশ্রুতি, যা একসময় ছিল জনগণের জন্য এক নতুন সূর্যোদয়, তা এখন রাজনীতির মোহে হারিয়ে যায়৷