উত্তরপ্রদেশে (Uttar Pradesh) দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরতে মেরুকরণকেই মূল হাতিয়ার করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। নির্বাচনের ঠিক আগে একের পর এক দলিত মন্ত্রী ও বিধায়ক দল ছাড়ায় এমনিতেই যথেষ্ট চাপে রয়েছেন যোগী। তার ওপর পাঁচ বছরের শাসনকালের রাজ্যের উন্নয়নে তেমন কোনও কাজই করতে পারেননি তিনি। সব মিলিয়ে যথেষ্ট ব্যাকফুটে রয়েছে যোগীর নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া যোগী তাই এবার নতুন করে মেরুকরণকেই তুরুপের তাস করেছেন।
ইতিমধ্যেই যোগী ঘোষণা করেছেন, এবার ৮০-র সঙ্গে ২০-র লড়াই হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে ২০ শতাংশ মুসলিমের বাস। ২০ শতাংশ বলতে যোগী স্পষ্টতই মুসলিম সম্প্রদায়কেই বুঝিয়েছেন। যোগীর পাঁচ বছরের শাসনকালে ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ও কায়স্থ সম্প্রদায় তাঁর উপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের আগে একের পর এক দলিত নেতা দল ছাড়ায় কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে উত্তরপ্রদেশ বিজেপি। সে কারণে দলের প্রার্থী তালিকায় এবার দলিত, মহিলা ও তফসিলি জাতির প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ প্রার্থী তালিকায় বিজেপি ৮৫ টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। যার মধ্যে ৪৯ টি আসনে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি এবং তপশিলি জাতি থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। ৩০ জন দলিত এবং এসসি সম্প্রদায়ের ১৯ জনকে প্রার্থী করেছে বিজেপি।
উত্তরপ্রদেশে এবার বিজেপিকে কার্যত টলিয়ে দিয়েছে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি। কিন্তু এরই মধ্যে তলে তলে বিজেপির পক্ষে কাজ করছে বহু জন সমাজ পার্টি।
মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন এই দল ইতিমধ্যেই বিজেপির পরিবর্তে সমাজবাদী পার্টিকেই আক্রমণ করে চলেছে। ২০১৭ সালের নির্বাচনেও মায়াবতীর চালেই কিস্তিমাত হয়েছিল। সমাজবাদী পার্টিকে উড়িয়ে দিয়ে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
প্রথম দফায় ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ৫৮ টি আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। ওই ৫৮ টি আসনের মধ্যে সপা ও আরএলডি জোট ১৩ জন মুসলিমকে প্রার্থী করেছে। কিন্তু মায়াবতীর বিএসপি ১৭ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। মায়াবতীর এই চালে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। কারণ মুসলিম ভোট এবার বিএসপি ও এসপির মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। মাঝখান থেকে হিন্দু ভোট পেয়ে কিস্তিমাত করবে বিজেপি। যে কারণে এই ৫৮ টি আসনে বিজেপি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাউকে প্রার্থী করেনি। এরইমধ্যে অল ইন্ডিয়া মুসলমিন বা মিমের প্রধান সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসি জানিয়েছেন, তাঁরা উত্তরপ্রদেশে শতাধিক আসনে লড়বেন। অর্থাৎ মিম যদি মুসলিম ভোটের বেশ কিছু অংশ কেটে নেয় সেক্ষেত্রেও বিজেপির সুবিধা হবে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, মায়াবতী এবং ওয়াইসিকে বিজেপি লড়াইয়ের ময়দানে এনে কৌশলী চাল দিয়েছে। বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই এই দুই দলকে কাজে লাগাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি। মায়াবতীর পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগগুলিকে সামনে এনে মায়াকে প্রবল চাপে ফেলে দিয়েছেন মোদি-শাহ।
পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী যোগী এবং অন্য বিজেপি নেতারা নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় মেরুকরণের জোরদার প্রচার করে চলেছেন। প্রায় প্রতিটি জনসভা থেকেই তাঁরা হিন্দুত্বের তাস খেলছেন। রাম মন্দির তো পরিচিত অস্ত্র, তাছাড়াও কাশী, বেনারস ও রাজ্যের অন্যান্য অংশেও লাগাতার হিন্দু মন্দির গড়ে তোলার কথা বলে চলেছেন যোগী ও তাঁর সহযোদ্ধারা। গো-বলয়ের এই বৃহত্তম রাজ্য সপার ভোটব্যাঙ্ক মূলত মুসলিম যাদব সম্প্রদায়। অন্যদিকে কংগ্রেস মহিলা ভোটারদের উপর নির্ভর করেছিল।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ দখলের লড়াইয়ে দলিত, নিচুজাত ও মহিলা প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিরোধীদের কৌশলকে অনেকটাই ভেস্তে দিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। পাশাপাশি চলছে চড়া হিন্দুত্ববাদী প্রচার। ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা বরাবরই বিজেপির পক্ষে ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু যোগীর কাজে এবার ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষ যথেষ্টই অসন্তুষ্ট। যোগী এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও এ বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। সেকারণেই তাঁরা আর শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের ভোটের উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাই তাঁরা দলিত ও নিচুজাতের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের ভোট কব্জা করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি মায়াবতী এবং ওয়াইসিকে দিয়ে মুসলিম ভোট কাটাকুটির খেলায় সপার চাল ভেস্তে দিতে চাইছেন। তবে শেষ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে কী হতে চলেছে সেটা জানতে গেলে সকলকেই ১০ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।