বাংলাদেশের দেখানো পথে হাঁটুক ভারত, তসলিমার পরামর্শ

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের যন্ত্রণার ইতিহাস এখনও ভুলতে পারেনি উপমহাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটিয়ে জন্ম নেয় দুটি নতুন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। এর ফলে কোটি কোটি…

Taslima Nasrin

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের যন্ত্রণার ইতিহাস এখনও ভুলতে পারেনি উপমহাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটিয়ে জন্ম নেয় দুটি নতুন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। এর ফলে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। সেই যন্ত্রণার ছাপ আজও রয়ে গেছে, বিশেষত শত্রু সম্পত্তি আইনকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখিকা তসলিমা নাসরিন (Taslima Nasrin) ভারতকে আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করতে।  তাঁর দাবি, শত্রু সম্পত্তি নামটি পরিবর্তন করে অর্পিত সম্পত্তি করা উচিত, যেমনটি বাংলাদেশ করেছে।

দেশভাগ এবং শত্রু সম্পত্তি আইন
দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান, ও বিহারের প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ মুসলমান চলে যায়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে যায় পশ্চিমবঙ্গের ৫-৬ লক্ষ বাঙালি মুসলমান। একইভাবে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২০-৩০ লক্ষ বাঙালি হিন্দু ভারতে চলে আসে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ অবাঙালি হিন্দু ও শিখ ভারতে আসে।

   

এরা সবাই বাড়ি-ঘর, জমি-সম্পত্তি ফেলে পালিয়ে আসে। এই ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ভারত ও পাকিস্তান সরকার “শত্রু সম্পত্তি” হিসেবে চিহ্নিত করে। নামটি শুধু সম্পত্তি দখলের বৈধতার জন্য ব্যবহৃত হয়নি, বরং এটি তাদের প্রতি একটি তীব্র অপমানের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, যারা দেশভাগের শিকার হয়েছিল।

বাংলাদেশের উদাহরণ
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে শত্রু সম্পত্তি আইনের নাম পরিবর্তন করে “অর্পিত সম্পত্তি” রাখে। তাদের যুক্তি ছিল, যারা দেশ ছেড়েছিল, তারা শত্রু নয়। বরং তারা ছিলেন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির শিকার। বাংলাদেশ সরকার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।

তসলিমা নাসরিন এই প্রসঙ্গে বলেন, “বাংলাদেশ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। যারা ভিটেমাটি ছেড়ে গিয়েছিল, তারা কোনোভাবেই শত্রু ছিল না। তারা ছিল দেশভাগের নিষ্ঠুর রাজনীতির বলি।”

ভারত ও পাকিস্তানে অপরিবর্তিত শত্রু সম্পত্তি আইন
অন্যদিকে, ভারত এবং পাকিস্তান এখনও এই আইনকে বহাল রেখেছে। এই আইন অনুযায়ী, যারা দেশভাগের সময় সম্পত্তি ফেলে চলে গিয়েছিল, তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। এটি “শত্রু সম্পত্তি” নামে পরিচিত। তসলিমা মনে করেন, এই নামকরণ শুধু ঐতিহাসিক অন্যায়কেই তুলে ধরে না, বরং দেশভাগের শিকার হওয়া মানুষদের প্রতি অসম্মানও করে।

তসলিমার আবেদন
তসলিমা নাসরিন ভারত সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “বাংলাদেশ যেভাবে তাদের আইন পরিবর্তন করেছে, ভারত এবং পাকিস্তানকেও সেই পথে হাঁটতে হবে। শত্রু সম্পত্তি শব্দটি ইতিহাসের একটি অমানবিক অধ্যায়কে বাঁচিয়ে রাখে। এটি পরিবর্তন করে অর্পিত সম্পত্তি বলা উচিত। এটি শুধু একটি নাম বদল নয়, বরং দেশভাগের শিকার হওয়া মানুষের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন।”

তিনি আরও বলেন, “যারা দেশ ছেড়েছে, তারা কোনো শত্রুতা করেনি। বরং তারা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের প্রতি এই অবিচার দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত নয়।”

মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহ্বান
তসলিমা মনে করেন, “শত্রু সম্পত্তি” নামকরণের মাধ্যমে যে মানসিক যন্ত্রণা তৈরি হয়, তা অযথা দীর্ঘস্থায়ী করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “শত্রু শব্দটি ব্যবহার করে ভারত এবং পাকিস্তান কেবল ঐতিহাসিক বিভেদের দেয়াল উঁচু করছে। এই শব্দটি মুছে ফেলে মানবিকতার জয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”

সমালোচনা ও সমর্থন
তসলিমার এই মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন, আবার কেউ এটিকে অযাচিত সমালোচনা হিসেবে দেখছেন। তবে, তাঁর মন্তব্য নতুন করে শত্রু সম্পত্তি আইন এবং দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

তসলিমার মতে, “বাংলাদেশ একটি মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভারত এবং পাকিস্তানকেও সেই পথ অনুসরণ করে শত্রু সম্পত্তির পরিবর্তে অর্পিত সম্পত্তি নামটি গ্রহণ করা উচিত। এটি মানবিকতার জয়।”