মণিপুরের (Manipur) ইম্ফল পূর্ব জেলায় শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মৈতৈ সম্প্রদায়ের একটি মন্দিরের দিকে সন্দেহভাজন কুকি জঙ্গিরা বেশ কয়েকটি গুলি চালিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এই ঘটনা ঘটেছে যখন রাজ্যের গভর্নর অজয় কুমার ভাল্লা সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য লুণ্ঠিত ও অবৈধভাবে রাখা অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ৬ মার্চ পর্যন্ত করেছেন। পূর্বের সময়সীমা শুক্রবারই শেষ হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী কাংপোকপি জেলার পাহাড়ের চূড়া থেকে এই গুলি চালানো হয়, যখন মৈতৈ সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য কংবা মারু মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। এই হামলায় কেউ হতাহত হননি বলে জানা গেছে। ঘটনাটি ইম্ফল শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে ঘটেছে। হামলার পর পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর একটি যৌথ দল নিকটবর্তী পাহাড়ে তল্লাশি চালায়। মন্দিরে প্রার্থনার জন্য আসা কাছাকাছি গ্রামের বাসিন্দারা সাংবাদিকদের জানান, এই ঘটনা তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
Also Read | Manipur: শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে মণিপুর, অবৈধ অস্ত্র জমা সংগঠনের
প্রতিবাদ ও রাজ্যপালের প্রতি দাবি
হামলার পর মৈতৈ সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য মন্দিরের দিকে যাওয়া রাস্তায় প্রতিবাদে নামেন। তারা স্লোগান দিয়ে রাজ্যপালের কাছে দাবি জানান যেন “কুকি জঙ্গিরা” এই ধরনের হামলা বন্ধ করে। একজন প্রতিবাদকারী বলেন, “আমরা শান্তিতে আমাদের ধর্ম পালন করতে চাই। এই হামলা বন্ধ করতে হবে।” প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে দেখা করা এক পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, “এই গুলি সম্ভবত একটি প্রতিক্রিয়া টানার চেষ্টা, যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সামান্য লক্ষণ দেখা গেলেই তা অশান্ত হয়ে ওঠে। জনগণের উচিত নিরাপত্তা বাহিনীকে এটি মোকাবিলা করতে দেওয়া। রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে, এবং ৬ মার্চ পর্যন্ত সবাইকে অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে। তারপর নিরাপত্তা বাহিনী আর এই ধরনের কিছু সহ্য করবে না।”
অরম্বাই তেংগলের অস্ত্র জমা ও পূর্বের প্রেক্ষাপট
এই ঘটনার একদিন আগে, বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি), মৈতৈ সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী অরম্বাই তেংগল (এটি) গভর্নরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশের কাছে ৩০০টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছিল। এই পদক্ষেপকে অনেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল। তবে, তার পরদিনই কংবা মারু মন্দিরে গুলি চালানোর ঘটনা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা প্রকাশ করেছে।
কংবা মারু মন্দিরটি ইতিপূর্বেও আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসে মৈতৈ এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর সন্দেহভাজন কুকি জঙ্গিরা এই মন্দিরে ভাঙচুর চালিয়েছিল। কংবা নদীর উৎসস্থলের কাছে অবস্থিত এই মন্দিরটি মৈতৈ সম্প্রদায়ের জন্য একটি পবিত্র স্থান।
মণিপুরে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত
মণিপুরে উপত্যকার প্রধান মৈতৈ সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি অঞ্চলে প্রভাবশালী এক ডজনেরও বেশি কুকি উপজাতির মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে সংঘর্ষ চলছে। ভূমি অধিকার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মতো বিষয় নিয়ে এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২৫০-এর বেশি মানুষ নিহত এবং ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন। ২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষের পর থেকে রাজ্যে অশান্তি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এবং তাঁর মন্ত্রী পরিষদ পদত্যাগ করেন। এরপর গভর্নর রাজ্য বিধানসভাকে ‘সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন’-এ রাখেন, অর্থাৎ বিধায়করা সক্রিয় থাকলেও তাঁদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গভর্নর অজয় কুমার ভাল্লা অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য সময়সীমা বাড়িয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
পুলিশ ও সিআরপিএফ-এর পদক্ষেপ
হামলার পর পুলিশ এবং সিআরপিএফ-এর যৌথ দল কাংপোকপির ওয়াকান পাহাড়ি পর্বতমালায় তল্লাশি অভিযান শুরু করে। স্থানীয়রা জানান, সন্দেহভাজন জঙ্গিরা পাহাড়ের উঁচু জায়গা থেকে ১০টিরও বেশি রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “আমরা এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, এবং এই ধরনের হামলা সহ্য করা হবে না।” তবে, এখনও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা
মৈতৈ সম্প্রদায়ের মানুষ এই হামলাকে কুকি জঙ্গিদের উস্কানি হিসেবে দেখছেন। একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা যখনই শান্তিতে ফিরতে চাই, তখনই তারা হামলা করে। এটা আমাদের ধর্মীয় স্থানের ওপর আক্রমণ।” অন্যদিকে, কুকি সম্প্রদায়ের কিছু নেতা অতীতে দাবি করেছেন যে, মৈতৈ সম্প্রদায় তাদের ওপর বৈষম্য করে এবং সম্পদ ও ক্ষমতার অসম বণ্টনের জন্য তারা একটি পৃথক প্রশাসন চান। এই দ্বন্দ্ব গত দুই বছরে রাজ্যের শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে।
কংবা মারু মন্দিরে এর আগেও হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ২০২৩ সালে জাতিগত সংঘর্ষের সময় এই মন্দিরের সম্পত্তি ভাঙচুর করা হয়েছিল। মৈতৈ সম্প্রদায়ের জন্য এই স্থানটির ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে, যা এই হামলাকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
গভর্নরের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ
গভর্নর ভাল্লা অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তিনি জানিয়েছেন, “আমরা সবাইকে আইন মেনে অস্ত্র জমা দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এরপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” অরম্বাই তেংগলের অস্ত্র জমা দেওয়া একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, কুকি জঙ্গিদের এই হামলা দেখিয়েছে যে, শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনও অনেক দূরে।
মণিপুরে জাতিগত সংঘর্ষের এই চক্র ভাঙতে নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মৈতৈ এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া না হলে এই অশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বর্তমানে, রাষ্ট্রপতির শাসনের মধ্যে এই হামলা শান্তির পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
মৈতৈ সম্প্রদায়ের মানুষ এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, “আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছি, কিন্তু তারা আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।” অনেকে এই হামলাকে শান্তি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপ এবং গভর্নরের হস্তক্ষেপই পারে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে।
মণিপুরের জনগণ এখন শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার পথ এখনও দীর্ঘ এবং কঠিন।