ওয়াকফ সম্পত্তির ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন (Waqf Property Registration) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ আপাতত বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। আগামী ছ’মাসের মধ্যে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত অনলাইন পোর্টালে নথিভুক্ত করার নির্দেশ কার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছে প্রধান বিচারপতি ভূষণ আর. গাভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। শুক্রবার আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ৬ জুন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের জারি করা বিজ্ঞপ্তি স্থগিত রাখা যাবে না, কারণ এই মামলার রায় ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “সমস্যাটা কোথায়? বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ছ’মাসের মধ্যে আপনারা সম্পত্তি নথিভুক্ত করুন। পরে আমাদের রায় অনুযায়ী সবকিছু নির্ধারিত হবে।” অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ চাইলেও আদালত জানিয়ে দেয়, রায় সংরক্ষিত থাকার সময়ে কোনো অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়।
ডিজিটাল পোর্টাল ‘UMEED’ বাধ্যতামূলক
কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি এখন থেকে ‘ইউমীদ’ (UMEED—Unified Waqf Management, Empowerment, Efficiency and Development) নামক ডিজিটাল পোর্টালে নথিভুক্ত করতে হবে। এখানে সম্পত্তির ছবি, জিওট্যাগ করা অবস্থানসহ সমস্ত তথ্য জমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন না হলে সেই সম্পত্তিকে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এবং প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে।
মামলার পটভূমি
২০২৫ সালের ওয়াকফ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে একাধিক আবেদন দায়ের হয় সুপ্রিম কোর্টে। মে মাসে টানা তিন দিন শুনানি শেষে ২২ মে বেঞ্চ রায় সংরক্ষিত রাখে। সেই শুনানিতে আদালত উল্লেখ করে, ১৯২৩ সাল থেকে শুরু করে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি সম্পর্কিত আইনে নথিভুক্তির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৪ সালের পর থেকে নিবন্ধন আইনের বাধ্যতামূলক অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
আবেদনকারীদের যুক্তি
সিনিয়র আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, নথিভুক্তির দায়িত্ব ওয়াকফ কর্তৃপক্ষের উপর চাপানো অন্যায্য। সরকারের ১৯৫৪ সাল থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ব্যর্থতার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়কে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সিব্বলের দাবি, এই আইন সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলিকে নিজেদের সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, নতুন আইনে বলা হয়েছে যে অন্তত পাঁচ বছর ধরে ইসলাম পালন করছেন এমন মুসলিম ব্যক্তিরাই কেবল ওয়াকফ সম্পত্তি উৎসর্গ করতে পারবেন। আবেদনকারীদের অভিযোগ, অন্য কোনো ধর্মীয় দান বা ট্রাস্টে এ ধরনের শর্ত নেই, ফলে আইনটি বৈষম্যমূলক।
কেন্দ্রের যুক্তি
সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, ২০১৩ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে ‘যে কেউ’ ওয়াকফ সম্পত্তি উৎসর্গ করতে পারবেন বলা হয়েছিল, যা ইসলামের মূল ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁর বক্তব্য, “ওয়াকফ একটি ইসলামি প্রতিষ্ঠান। সেখানে অমুসলিম ব্যক্তি কীভাবে সম্পত্তি উৎসর্গ করবেন?”
নতুন আইনে তফসিলি উপজাতিদের জমিতে ওয়াকফ সম্পত্তি তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মেহতার মতে, এর উদ্দেশ্য উপজাতিদের সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষা করা। তবে আদালত প্রশ্ন তোলে—“ধর্ম তো একই থাকে, সাংস্কৃতিক প্রথা আলাদা হলেও ওয়াকফ নিষিদ্ধ করার যৌক্তিকতা কোথায়?”
অন্যান্য আপত্তি
সিনিয়র আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান ও অভিষেক মনু সিংভি অভিযোগ করেন, নতুন আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষম্য করছে এবং দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত বহু সম্পত্তি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ধাওয়ানের মতে, দান ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি, অথচ এই আইন তা বাধাগ্রস্ত করছে। সিংভির যুক্তি, নথিভুক্তি ও সরকারি আপত্তি মিলিয়ে একটি “ভয়ঙ্কর চক্র” তৈরি হচ্ছে, যাতে প্রকৃত ওয়াকফ সম্পত্তিও স্বীকৃতি পাবে না।
একদিকে কেন্দ্র দাবি করছে, আইনটি স্বচ্ছতা আনবে, অপব্যবহার রোধ করবে এবং সম্পত্তি রক্ষায় সাহায্য করবে। অন্যদিকে আবেদনকারীরা বলছেন, এতে মুসলিমদের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার খর্ব হচ্ছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি ডিজিটাল পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক থাকছে।