সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) পঞ্জাব এবং হরিয়ানা সরকারকে খড় পোড়ানো (স্টাবল বার্নিং) নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে একজন পরিবেশকর্মীর দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, এই আবেদনে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য বা বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি। বিচারপতি অভয় এস ওকা এবং উজ্জ্বল ভূঁইয়ার বেঞ্চ জানিয়েছে, যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে খড় পোড়ানোর বিষয়ে একাধিক আদেশ জারি করেছে এবং এই মামলা এখনও আদালতের বিবেচনাধীন রয়েছে, তাই এ ধরনের আবেদনকে উৎসাহ দেওয়া হবে না।
বিচারপতিরা বলেন, “যখন এই আদালত খড় পোড়ানোর বিষয়ে বেশ কয়েকটি আদেশ পাস করেছে এবং এখনও এই বিষয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা বিভিন্ন পক্ষকে শুধুমাত্র আবেদন দাখিল বা নির্দেশনার জন্য হস্তক্ষেপের আবেদন করতে উৎসাহিত করতে চাই না। তাই এই আবেদন খারিজ করা হল।”
পরিবেশকর্মী বিক্রান্ত তোঙ্গড়ের দায়ের করা এই আবেদনে বলা হয়েছিল, এপ্রিল-মে মাসে খড় পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট দূষণ শুধু দিল্লি-এনসিআর-এর মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং যে রাজ্যগুলোতে এটি পোড়ানো হয়, সেখানকার বাসিন্দাদের জন্যও বিপজ্জনক। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্করা এর দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবেদনে আরও বলা হয়, “বায়ু দূষণ এখন একটি বার্ষিক জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে, যা দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে এবং ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৯ এবং ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। গত কয়েক দশক ধরে এই আদালতের অসংখ্য নির্দেশনা সত্ত্বেও, এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন খুবই নগণ্য। সরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।”
খড় পোড়ানো: একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা
পঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো উত্তর ভারতের কৃষি-নির্ভর রাজ্যগুলোতে ধান কাটার পর খড় পোড়ানো একটি সাধারণ প্রথা। এটি কৃষকদের জন্য একটি দ্রুত ও সস্তা পদ্ধতি হলেও, এর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ও দূষণ দিল্লি-এনসিআর সহ আশপাশের অঞ্চলে বায়ুর গুণমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে, যখন বাতাসের গতি কম থাকে, তখন এই দূষণ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রায়ই ‘বিপজ্জনক’ স্তরে পৌঁছে যায়, যা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।
আদালতের পূর্ববর্তী পদক্ষেপ
সুপ্রিম কোর্ট গত কয়েক বছরে খড় পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষকদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা যেমন স্টাবল ম্যানেজমেন্ট মেশিনের ভর্তুকি, জৈব-বিচ্ছেদকারী রাসায়নিকের ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির প্রচার। আদালত কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (সিএকিউএম)-কে এই বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে। এছাড়া, পঞ্জাব ও হরিয়ানা সরকারকে জরিমানা আরোপ এবং কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবুও, এই নির্দেশনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও অধরা।
আবেদনকারীর যুক্তি
বিক্রান্ত তোঙ্গড় তাঁর আবেদনে জানিয়েছেন, খড় পোড়ানোর ফলে শুধু শীতকালেই নয়, এপ্রিল-মে মাসেও উল্লেখযোগ্য দূষণ হয়, যা সাধারণত আলোচনায় কম গুরুত্ব পায়। তিনি বলেন, “এই সময়ে উৎপন্ন ধোঁয়া দিল্লি-এনসিআর ছাড়াও পঞ্জাব ও হরিয়ানার গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারীদের জন্যও ক্ষতিকর। শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসের সমস্যা, চোখের জ্বালাপোড়া এবং অন্যান্য রোগে ভোগার ঝুঁকি বাড়ছে।” তিনি আরও যুক্তি দিয়েছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতা এবং কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্পের অভাব এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
কেন আবেদন খারিজ?
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ করেছে যে, আবেদনে কোনো নতুন তথ্য বা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, যা আদালতের বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত। এছাড়া, আদালত এই বিষয়ে ইতিমধ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে আরও একটি সমান্তরাল আবেদন গ্রহণ করা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেছে। বিচারপতিরা স্পষ্ট করেছেন, এ ধরনের আবেদন যদি শুধুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দায়ের করা হয়, তবে তা আদালতের সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়।
পরিবেশবিদদের প্রতিক্রিয়া
এই রায়ে পরিবেশবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, আদালতের এই সিদ্ধান্ত সরকারের উপর চাপ বাড়ানোর পরিবর্তে সমস্যার সমাধানকে আরও পিছিয়ে দেবে। অন্যদিকে, কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, আদালত ইতিমধ্যে এই বিষয়ে যথেষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে, এবং এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের।
সমাধানের পথ
খড় পোড়ানোর সমস্যা সমাধানে কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী বিকল্প অত্যন্ত জরুরি। হ্যাপি সিডার মেশিনের মতো যন্ত্রপাতি ব্যবহার, খড় থেকে জৈব-জ্বালানি উৎপাদন এবং কৃষি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি এই সমস্যা কমাতে পারে। তবে, এর জন্য কৃষকদের আর্থিক সহায়তা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এই দিকে কাজ করছে, কিন্তু ফলাফল এখনও সন্তোষজনক নয়।
জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দিল্লি-এনসিআর-এ শীতকালে একিউআই ৪০০-৫০০ ছাড়িয়ে যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি। এই পরিস্থিতি শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, গ্রামীণ এলাকাতেও স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় খড় পোড়ানোর সমস্যা সমাধানে নতুন দিশা না দিলেও, এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে আদালত এই বিষয়ে সক্রিয় রয়েছে। তবে, পরিবেশ রক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারি সংস্থাগুলোর আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। কৃষক, সরকার এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে।