প্রাকৃতিক বিপর্যন্ত মরণফাঁদ (Sikkim) সিকিম। মঙ্গন জেলায় প্রবল বর্ষণে ভূমিধ্বসের ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরকারী সূত্রে জানানো হয়েছে, এই জেলার দুই বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র লাচেন ও লাচুং-এ প্রায় দেড় হাজার পর্যটক আটেক পড়েছেন। যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে সড়ক সংযোগ চালু করার জন্য কাজ চলেছে। পর্যটকদের পরিস্হিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাইরে বেরতে নিষেধ করা হয়েছে। সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে এমন জানাচ্ছে আকাশবাণী সংবাদ।
উত্তর সিকিমে বর্ষা তীব্রতর হচ্ছে। ধসে বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ। মঙ্গন জেলার লাচেন এবং লাচুং-এর মতো পর্যটন কেন্দ্রে ১,২৭৬ জনেরও বেশি দেশীয় পর্যটক এবং দুজন বিদেশী নাগরিক আটকে পড়েছেন।
অবিরাম বৃষ্টিপাত, ভূমিধস এবং তিস্তা নদীর জল বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি ভ্রমণ এবং উদ্ধার প্রচেষ্টা বিঘ্নিত। রবিবার ধস সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নতুন করে ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটেছে।
গত ২৯ মে মুন্সিথাং-এ তিস্তা নদীতে গাড়ি ডুবে যাওয়ার পর নিখোঁজ আট পর্যটক এখনও খুঁজে পাননি। ২০২৩ সালে ভয়াবহ হিমবাহ হ্রদের আউটবার্স্ট বন্যার পর নবনির্মিত ফিদাং বেইলি ব্রিজটি উত্তাল জলের কারণে এর ভিত্তির কাঠামোগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
রবিবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং জিআরইএফ (জেনারেল রিজার্ভ ইঞ্জিনিয়ার ফোর্স) জরুরি পরিষেবার আংশিক সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে, তবে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক।
মঙ্গনের পুলিশ অফিসার সোনম দেচু ভুটিয়া বলেন, শুক্রবার রাতে আপার জঙ্গুর শিপগায়ারে নতুন করে ভূমিধসের ফলে পথটি বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে বিলম্ব হয়… রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভঙ্গুর হওয়ায়, অঞ্চলটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।
মঙ্গন জেলা পঞ্চায়েত উপাধ্যক্ষ সোনম কিপা ভুটিয়া বলেন উত্তর সিকিমের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ পর্যটক এখনও উঁচু পাহাড়ে আটকে পড়ে থাকতে পারেন। ফিদাং সেতুই ছিল আমাদের একমাত্র আশা, এমনকি এটিও এখন হুমকির মুখে।
সিকিম,উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য, সম্প্রতি এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। হিমালয়ের কোল ঘেঁষা এই রাজ্যটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ হলেও ভূ-প্রকৃতিগতভাবে এটি একটি ভঙ্গুর এলাকা। চলতি বছরে (২০২৪-২০২৫), ভারী বৃষ্টিপাত, হিমবাহের গলন এবং হঠাৎ করে গ্লেশিয়াল লেক আউটবার্স্ট (GLOF) এর কারণে সিকিম এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ছাঙ্গু লেক সংলগ্ন এলাকায় একটি গ্লেশিয়াল লেক ফেটে যাওয়ার ফলে নদীর প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যায়। এতে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় নদীর তীরবর্তী বহু গ্রাম ও শহর। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মঙ্গন, চুংথাং ও লাচেন অঞ্চলের এলাকাগুলি। হড়পা বানে বহু মানুষ নিখোঁজ হয় এবং অন্তত ৭০ জনের মৃত্যু হয় বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়ে পড়ে।
প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। গ্রীষ্মে হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে হ্রদগুলোতে অতিরিক্ত জল জমে থাকে। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে এই হ্রদগুলোর প্রাচীর ভেঙে গেলে সেগুলি হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই হিমালয়াঞ্চলে এই ধরনের বিপদের আশঙ্কা করে আসছিলেন।
বিপর্যয়ের ফলে সিকিমের রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ সংযোগ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে যায়। জাতীয় সড়ক ১০-এর একাধিক অংশ ধসে পড়ে, ফলে রাজধানী গ্যাংটক এবং অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বহু পর্যটক আটকে পড়েন, যাদের উদ্ধারে ভারতীয় সেনা ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সরকারি ও বেসরকারি স্তরে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ জোরকদমে শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী উভয়েই এই দুর্যোগে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং দ্রুত পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই ঘটনা প্রমাণ করে হিমালয়াঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময় প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা কতটা জরুরি। বাঁধ নির্মাণ, রাস্তা কাটা, বন উজাড় ইত্যাদি প্রকল্পে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন না করায় ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সিকিমের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেবল একটি স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং এটি বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া এবং উন্নয়নের অন্ধ গতির এক সতর্ক সংকেত। সময় এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতা করে, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পথে হাঁটার। তারা বলছেন, সিকিমের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের অন্যান্য হিমালয় সংলগ্ন রাজ্যগুলোকেও আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে।