১৮ দিন পর প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ রাকেশ উত্তরসূরি শুভাংশুর

ভারতের জন্য এক গৌরবময় মুহূর্তে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা (Shubhangshu) এবং অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনের ক্রু সদস্যরা স্পেসএক্স-এর ড্রাগন মহাকাশযানে করে প্রশান্ত মহাসাগরে সফলভাবে…

Shubhanshu Shukla

ভারতের জন্য এক গৌরবময় মুহূর্তে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা (Shubhangshu) এবং অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনের ক্রু সদস্যরা স্পেসএক্স-এর ড্রাগন মহাকাশযানে করে প্রশান্ত মহাসাগরে সফলভাবে অবতরণ করেছেন। এই ঘটনা ঘটেছে ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই, বিকেল ৩:০১ মিনিটে (ভারতীয় সময়) ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো উপকূলে।

এই মিশনের মাধ্যমে শুক্লা ১৮ দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন, যা ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই মিশনটি অ্যাক্সিয়ম স্পেস এবং স্পেসএক্সের সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে শুক্লা মিশনের পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমান্ডার পেগি হুইটসন (যুক্তরাষ্ট্র), মিশন স্পেশালিস্ট স্লাওয়োজ উজনানস্কি-উইশনিয়েভস্কি (পোল্যান্ড) এবং তিবোর কাপু (হাঙ্গেরি)।

   

মিশনের যাত্রা ও অবতরণ

অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশন ২৫ জুন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেসএক্স-এর ফ্যালকন ৯ রকেটে করে উৎক্ষেপিত হয়। এই মিশনের মাধ্যমে শুভাংশু শুক্লা ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে যাত্রা করেন এবং প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইএসএস-এ পৌঁছান। ২৬ জুন বিকেল ৪:০৫ মিনিটে ড্রাগন মহাকাশযান ‘গ্রেস’ আইএসএস-এর হারমনি মডিউলের সঙ্গে সফলভাবে সংযুক্ত হয়।

১৮ দিনের এই মিশনে ক্রু সদস্যরা ৬০টির বেশি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেন, যার মধ্যে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র সাতটি পরীক্ষা ছিল। এই পরীক্ষাগুলির মধ্যে ছিল মাইক্রোগ্রাভিটিতে পেশি ক্ষয়, মহাকাশে হজম প্রক্রিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য, মাইক্রোঅ্যালগি চাষ এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা।

১৪ জুলাই বিকেল ৪:৩৫ মিনিটে (ভারতীয় সময়) ড্রাগন মহাকাশযান আইএসএস থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ২২.৫ ঘণ্টার যাত্রার পর ১৫ জুলাই বিকেল ৩:০১ মিনিটে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। এই অবতরণ প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ড্রাগন মহাকাশযান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় প্রায় ২৭,০০০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে ছুটছিল এবং তাপরক্ষক ঢাল ১,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করেছে।

অবতরণের আগে, ২:০৭ মিনিটে ডি-অরবিট বার্ন শুরু হয়, যা ১৮ মিনিট ধরে চলে। এরপর, ২:২৬ মিনিটে মহাকাশযানের ট্রাঙ্ক বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ২:৫৭ মিনিটে ৫.৭ কিমি উচ্চতায় স্টেবিলাইজিং প্যারাশুট এবং ২ কিমি উচ্চতায় মূল প্যারাশুট মোতায়েন করা হয়। এই প্যারাশুটগুলি মহাকাশযানের গতি ৭ মিটার/সেকেন্ডে কমিয়ে নিরাপদ অবতরণ নিশ্চিত করে।

শুক্লার বিদায়ী বার্তা

আইএসএস থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শুভাংশু শুক্লা একটি আবেগপ্রবণ বার্তা দিয়েছেন, যেখানে তিনি ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার বিখ্যাত উক্তি “সারে জাহান সে আচ্ছা” উল্লেখ করে বলেন, “৪১ বছর আগে একজন ভারতীয় মহাকাশে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ভারত মহাকাশ থেকে কেমন দেখায়। আজকের ভারত মহাকাশ থেকে উচ্চাভিলাষী, নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী এবং গর্বে ভরপুর দেখায়… আজকের ভারত এখনও ‘সারে জাহান সে আচ্ছা’।” এই বার্তা ভারতীয়দের মধ্যে গর্ব এবং উৎসাহের সঞ্চার করেছে।

পরিবার ও দেশের প্রতিক্রিয়া

Advertisements

শুভাংশু শুক্লার পরিবার, বিশেষ করে তাঁর বাবা শম্ভু দয়াল শুক্লা এবং মা আশা শুক্লা, লখনউতে তাঁর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য উদ্বিগ্ন এবং উৎফুল্ল ছিলেন। তাঁর বাবা বলেন, “আমরা খুব উত্তেজিত যে আমাদের ছেলে মিশন থেকে ফিরছে। এটি ইতিহাসে লেখা হবে।

আমরা তাঁর নিরাপদ অবতরণের জন্য প্রার্থনা করছি।” তাঁর মা বলেন, “আমরা হনুমানজির দর্শন করেছি এবং সুন্দরকাণ্ড পাঠ করেছি। আমরা আমাদের ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি।” কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং এক্স-এ পোস্ট করে বলেন, “সমগ্র জাতি তোমার প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে, শুভাংশু!”

মিশনের তাৎপর্য

অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশন ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই মিশন ভারতের গগনযান প্রোগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে, যা ২০২৭ সালে ভারতের প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশ মিশন পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।

শুক্লার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষ করে মাইক্রোগ্রাভিটিতে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং মানব স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা, ভবিষ্যৎ মহাকাশ মিশন এবং পৃথিবীতে কৃষি ও চিকিৎসা গবেষণায় অবদান রাখবে। ইসরো জানিয়েছে, শুক্লা সাতটি পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন, যার মধ্যে ক্রমাগত গ্লুকোজ মনিটরিং এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা উল্লেখযোগ্য।

“প্লিজ, আমাদের যেতে দিন”, আচমকাই অরিজিৎ-এর গাড়ি আটকে অনুগামীরা

পুনর্বাসন প্রক্রিয়া

পৃথিবীতে ফিরে আসার পর শুক্লা এবং তাঁর ক্রু সদস্যরা একটি সাত দিনের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবেন, যাতে তাঁদের শরীর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে পুনরায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এই প্রক্রিয়া ফ্লাইট সার্জনদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। অবতরণের পর স্পেসএক্স-এর রিকভারি জাহাজ ক্রুদের উদ্ধার করে এবং প্রাথমিক চিকিৎসা পরীক্ষার জন্য হেলিকপ্টারে করে হিউস্টনে নিয়ে যাওয়া হবে।

শুভাংশু শুক্লার এই মিশন ভারতের মহাকাশ গবেষণায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তাঁর সফল প্রত্যাবর্তন এবং বৈজ্ঞানিক অবদান ভারতের মহাকাশে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই ঘটনা শুধু ভারতীয়দের জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্প্রদায়ের জন্যও একটি গর্বের মুহূর্ত।

আমাদের Google News এ ফলো করুন

২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।

Google News Follow on Google News