ভারতের অর্থনীতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে একাধিক সমালোচনামূলক বক্তব্য শোনা গিয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে। অনেকেই দাবি করেছিলেন যে দেশীয় অর্থনীতি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সেই ধারণায় কার্যত জল ঢেলে দিল সরকারি তথ্য ও শীর্ষ গবেষণা রিপোর্ট। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিক অর্থাৎ জুন ৩০ পর্যন্ত সময়ে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৮ শতাংশে, যা বাজারের প্রত্যাশিত ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশের অনেক ওপরে। এসবিআই রিসার্চ তাদের সাম্প্রতিক ইকো-র্যাপ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই সংখ্যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে ভারতীয় অর্থনীতি কেবল স্থিতিশীল নয়, বরং অত্যন্ত সক্রিয় ও প্রাণবন্ত অবস্থায় রয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের একই সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৫ শতাংশ এবং ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই বছরের প্রথম তিন মাসে ভারতের অর্থনীতি নতুন মাত্রা স্পর্শ করেছে। কেবল জিডিপি নয়, নামমাত্র জিডিপি (Nominal GDP) বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ হারে। একই সঙ্গে কোর জিভিএ (GVA থেকে কৃষি ও সরকারি খাত বাদ দিলে) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় এক শতাংশ বেশি।
এসবিআই রিসার্চ জানিয়েছে, এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হল উৎপাদন ও পরিষেবা খাত। প্রথম ত্রৈমাসিকে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৭ শতাংশ এবং পরিষেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৯.৩ শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে, সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে পরিষেবা খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৬৮ শতাংশ এবং উৎপাদন খাতের অবদান ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জিভিএ বৃদ্ধির প্রায় ৮৫ শতাংশই এসেছে এই দুই খাত থেকে।
এসবিআই রিসার্চ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণকে এই অপ্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছে—
১. উৎপাদন ক্ষেত্রে অগ্রগতি: শিল্পোৎপাদন সূচক (IIP) অনুযায়ী প্রথম ত্রৈমাসিকে তালিকাভুক্ত পণ্যের অর্ধেকেরও বেশি পণ্যে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯৪ শতাংশ পর্যন্ত। গবেষণা রিপোর্ট বলছে, বাজারের অনিশ্চয়তা বিবেচনা করে বহু শিল্প সংস্থা অগ্রিম উৎপাদনের পথ বেছে নিয়েছে, যা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
২. পরিষেবা খাতের জোয়ার: পর্যটন সংশ্লিষ্ট খাত—যেমন রেল, বিমান চলাচল এবং হোটেল বুকিং—সব ক্ষেত্রেই প্রবল চাহিদা দেখা গেছে। এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি পরিষেবা খাতের সংখ্যাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
৩. আবাসন খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি: ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হারে পরিবর্তন আনে। এর ফলে গৃহঋণ বিতরণে গতি এসেছে। যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম, তবুও এটি আবাসন খাতের প্রবৃদ্ধিকে টেনে তুলতে সাহায্য করেছে।
৪. ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি: ব্যক্তিগত ভোগব্যয় ৭ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয় (Capex) এই ত্রৈমাসিকে বাজেটের প্রায় ২৪.৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জোয়ারের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, যখন ব্যক্তিগত খরচ ইতিমধ্যেই শক্তিশালী, তখন কি জিএসটি হারে ছাড় দেওয়া উচিত? এসবিআই রিসার্চ বলছে, অতীতে যেমন ২০১৮ সালের জুলাই ও ২০১৯ সালের অক্টোবরে জিএসটি হারে পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা দেখায় যে জিএসটি কমালে স্বল্পমেয়াদে রাজস্ব কিছুটা কমলেও দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব আয় বাড়ে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিএসটি কমালে তাৎক্ষণিকভাবে মাসিক রাজস্ব প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা কমতে পারে, বার্ষিক ভিত্তিতে যা দাঁড়াবে প্রায় ৬০,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব বৃদ্ধির হার মাসিক ভিত্তিতে ৫-৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অতীতে এর ফলে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এসবিআই রিসার্চ মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের একটি সহজ-সরল জিএসটি কাঠামো বাস্তবায়িত হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য তা লাভজনক হবে। তাই জিএসটি হারে পরিবর্তনকে কেবল ভোগব্যয় বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং তা একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কার হিসেবে গ্রহণ করা দরকার।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতীয় অর্থনীতি “জীবন্ত এবং শক্তিশালী”। বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় বিতর্কের বাইরে থেকেও ভারতের প্রবৃদ্ধি তার গতি বজায় রেখেছে। উৎপাদন ও পরিষেবা খাতের শক্তিশালী পারফরম্যান্স এবং ভোগব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামী মাসগুলিতেও ভারতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে।
বিশ্লেষক মহলের মতে, এই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতির আসন ধরে রাখবে। একইসঙ্গে, শিল্পোৎপাদন, পরিষেবা খাত এবং সরকারি ব্যয়ের সুষম সমন্বয় দেশকে আরও উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে, ভারতের প্রথম ত্রৈমাসিকের ৭.৮% জিডিপি প্রবৃদ্ধি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং দেশীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তির প্রতিফলন। এসবিআই রিসার্চের ভাষায়, “ভারতীয় অর্থনীতি জীবন্ত, সক্রিয় এবং শব্দহীন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে এগিয়ে চলছে।”