বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) দলের প্রথমবারের আইপিএল জয় উদযাপনের সময় ভয়াবহ ভিড়ের ঘটনায় (Bengaluru Stamped) ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় বেঙ্গালুরু পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন আরসিবি’র শীর্ষ বিপণন কর্মকর্তা নিখিল সোসালে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিখিলকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি তিনজন গ্রেপ্তার ব্যক্তি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ডিএনএ এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের সদস্য, তবে তাদের পরিচয় এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এই ঘটনায় কর্ণাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (কেএসসিএ) দুই কর্মকর্তা—সেক্রেটারি শঙ্কর এবং ট্রেজারার জয়রাম—পলাতক রয়েছেন, এবং পুলিশ তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই ঘটনা বেঙ্গালুরুতে ব্যাপক শোক ও রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
ঘটনার বিবরণ
৪ জুন, ২০২৫, বুধবার সন্ধ্যায় চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আরসিবি ১৮ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আইপিএল ২০২৫-এর শিরোপা জিতেছে, এবং এই জয় উদযাপনের জন্য হাজার হাজার ভক্ত স্টেডিয়ামের চারপাশে জড়ো হয়েছিলেন। পুলিশের মতে, প্রায় ২-৩ লক্ষ মানুষ স্টেডিয়ামের ১ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা মাত্র ৩৫,০০০। এই অতিরিক্ত ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। স্টেডিয়ামের গেট ৩, ১২ এবং ১৮ বন্ধ করা হলে ভক্তরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে এবং দেয়ালে উঠে প্রবেশের চেষ্টা করে, যার ফলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ১১ জন মারা যান, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ, এবং ৪৭ জনেরও বেশি আহত হন।
পুলিশ ও সরকারের পদক্ষেপ
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এই ঘটনার পর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বেঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার বি দয়ানন্দ সহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সাসপেন্ড করা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন কাব্বন পার্ক থানার ইন্সপেক্টর, স্টেশন হাউস অফিসার, সেন্ট্রাল ডিভিশনের ডিসিপি, এবং স্টেডিয়ামের দায়িত্বে থাকা এসিপি। সিনিয়র আইপিএস অফিসার সীমান্ত কুমার সিংকে নতুন বেঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আরসিবি, ডিএনএ এন্টারটেইনমেন্ট, এবং কেএসসিএ’র প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। কাব্বন পার্ক থানায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, যাতে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যা নয় এমন দায়ী হত্যা, স্বেচ্ছায় আঘাত করা, এবং অবৈধ সমাবেশ। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-কে, এবং একটি বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করা হবে।
মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, প্রাক্তন কর্ণাটক হাইকোর্টের বিচারপতি মাইকেল ডি’কুনহার নেতৃত্বে একটি একক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে, যারা ৩০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে। এছাড়া, কর্ণাটক হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই ঘটনার বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা নিয়েছে এবং রাজ্য সরকারের কাছে বিস্তারিত স্ট্যাটাস রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। সরকার প্রতিটি মৃতের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক বিতর্ক
এই ঘটনা রাজ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারের পদত্যাগ দাবি করেছে। বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র এই ঘটনার সঙ্গে তেলেঙ্গানায় অভিনেতা আল্লু অর্জুনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলার তুলনা করে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, সরকার এই ঘটনায় দায় এড়াতে চাইছে এবং দুর্বল পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য দায়ী। অন্যদিকে, কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে “নোংরা রাজনীতি” করার অভিযোগ তুলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র ইয়াতিন্দ্র সিদ্দারামাইয়া বলেছেন, আরসিবি’র অনুরোধে এই ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছিল, এবং পুলিশ প্রাথমিকভাবে অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেও পরে অনুমোদন দেয়।
আরসিবি’র প্রতিক্রিয়া
আরসিবি এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং প্রতিটি মৃতের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা করেছে। ফ্র্যাঞ্চাইজির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সমস্ত আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে। তবে, ক্রিকেট বিশ্লেষক ও প্রাক্তন ক্রিকেটাররা এই ইভেন্টের তাড়াহুড়ো করে আয়োজনের সমালোচনা করেছেন। প্রাক্তন ভারতীয় পেসার মদন লাল বলেছেন, আরসিবি’র এই ইভেন্ট আরও দুই-তিন দিন পরে আয়োজন করা উচিত ছিল, যাতে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তিনি বিসিসিআই-কে দায়ী না করলেও আরসিবি’র দায়িত্বশীলতার অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
ইভেন্টের পটভূমি ও ভিড়ের কারণ
আরসিবি’র আইপিএল জয় বেঙ্গালুরুর ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য একটি আবেগপ্রবণ মুহূর্ত ছিল। ইভেন্টের পরিকল্পনা ছিল বিধান সৌধা থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত একটি বিজয়ী শোভাযাত্রা এবং স্টেডিয়ামে একটি সমাবেশ। তবে, পুলিশের মতে, আরসিবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছিল যে ইভেন্টে বিনামূল্যে প্রবেশের পাস পাওয়া যাবে, যা ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এই ঘোষণার পর ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশের পূর্বাভাস ছিল মাত্র ১ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি।
সামাজিক ও আইনি প্রভাব
এই ঘটনা ভারতে গণ-ইভেন্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। গত এক বছরে ভারতে ছয়টি বড় ভিড়ের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের এই ঘটনা আয়োজকদের দায়িত্বশীলতা এবং পুলিশের প্রস্তুতির ঘাটতি তুলে ধরেছে। ভক্তরা, বিশেষ করে তরুণরা, তাদের প্রিয় ক্রিকেটারদের দেখার জন্য উন্মুখ ছিলেন, কিন্তু পরিকল্পনার অভাব এই উৎসবকে ট্র্যাজেডিতে পরিণত করেছে।
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আরসিবি’র বিজয় উদযাপনের এই ঘটনা বেঙ্গালুরুর ক্রিকেট ভক্তদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। নিখিল সোসালে সহ চারজনের গ্রেপ্তার এবং কেএসসিএ কর্মকর্তাদের পলাতক থাকা এই ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরে। সরকার ও পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও, এই ঘটনা ভবিষ্যতে গণ-ইভেন্টের জন্য আরও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়। এই ট্র্যাজেডি কেবল শোকের নয়, বরং শিক্ষারও একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।