উত্তরপূর্ব ভারতের বিরল খনিজ ভান্ডার! নিমেষে বদলাতে পারে দেশের অর্থনীতি

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, (Northeast India) যা হিমালয়ের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এবং চীনের সীমান্তবর্তী, বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজের এক বিশাল অব্যবহৃত ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত…

Northeast India rare minerals

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, (Northeast India) যা হিমালয়ের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এবং চীনের সীমান্তবর্তী, বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজের এক বিশাল অব্যবহৃত ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা সংস্থা এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ৭০ মিলিয়ন টনেরও বেশি খনিজ ও বিরল মৃত্তিকা সম্পদ রয়েছে।

এই বিরল খনিজ ভারতের দূষণমুক্ত শক্তি রূপান্তর, ডিজিটাল পরিকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং প্রতিরক্ষা উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই আবিষ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে একটি প্রধান আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের মতো পাঁচটি রাজ্যে গ্রাফাইট, ভ্যানাডিয়াম, লিথিয়াম এবং কোবাল্টের মতো খনিজ সম্পদের প্রচুর মজুদ পাওয়া গেছে।

   

এই খনিজ গুলি ব্যাটারি, সেমিকন্ডাক্টর এবং উন্নত অ্যালয় তৈরিতে অপরিহার্য। এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন, যেমন ওফিওলাইট বেল্ট, ক্ষারীয় কমপ্লেক্স এবং গ্রাফাইট-ধারণকারী শিস্ট, বিরল খনিজের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অরুণাচল প্রদেশের পাপুম পাড়ে জেলার লোডোসো অঞ্চলে ২.১৫ মিলিয়ন টন বিরল মৃত্তিকা-ধারণকারী ফেরুজিনাস ফিলাইটের মজুদ পাওয়া গেছে, যার গড় গ্রেড ১.০৮% মোট বিরল মৃত্তিকা (ইট্রিয়াম সহ)।

এছাড়াও, পূর্ব কামেং এবং পশ্চিম সিয়াং জেলায় নিওডিয়ামিয়ামের উল্লেখযোগ্য ঘনত্ব পাওয়া গেছে, যা বৈদ্যুতিক যান এবং বায়ু টারবাইনের জন্য স্থায়ী চুম্বক তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসমের কর্বি আংলং জেলার জাশোরা অ্যালকালাইন কমপ্লেক্সে ২৮.৬ মিলিয়ন টন বিরল মৃত্তিকা সম্পদের মজুদ পাওয়া গেছে।

মেঘালয়ের সাং ভ্যালি, যা পশ্চিম জয়ন্তিয়া এবং পূর্ব খাসি পাহাড় জেলায় বিস্তৃত, ল্যাটেরাইট-আধারিত বিরল মৃত্তিকা নিষ্কাশনের জন্য একটি সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নাগাল্যান্ড এবং মণিপুরে ওফিওলাইট বেল্টে নিকেল, কোবাল্ট এবং ক্রোমিয়ামের মতো খনিজ পাওয়া গেছে, যদিও এগুলোর বাণিজ্যিক নিষ্কাশনের জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন।

এই আবিষ্কার ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। বর্তমানে, চীন বিশ্বের বিরল মৃত্তিকা পরিশোধনের প্রায় ৯০% নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভারত তার বিরল মৃত্তিকা আমদানির ৮১% চীন থেকে সংগ্রহ করে। চীনের সাম্প্রতিক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতের বৈদ্যুতিক যানবাহন, প্রতিরক্ষা এবং ইলেকট্রনিক্স শিল্পে সরবরাহ শৃঙ্খলার উপর চাপ পড়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই সম্পদ ভারতকে চীনের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং দেশীয় সরবরাহ শৃঙ্খলা গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশগত সংবেদনশীলতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং পরিশোধন প্রযুক্তির অভাব এই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহারকে জটিল করে তুলছে।

Advertisements

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে খনিজ নিষ্কাশন ও পরিশোধনের জন্য উচ্চ ব্যয় এবং পরিবেশগত প্রভাব এই প্রক্রিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক করে তুলতে পারে। ভারত সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৫ সালে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ মিশন চালু করা হয়েছে, যা ২০৩১ সাল পর্যন্ত ১,২০০টি অনুসন্ধান প্রকল্প পরিচালনার লক্ষ্য নিয়েছে।

এছাড়াও, খনিজ আইন সংশোধন করে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ডে ৩৮টি সম্ভাবনাময় খনিজ ব্লক ইতিমধ্যে নিলামের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতটি ইতিমধ্যে নিলাম সম্পন্ন হয়েছে।

ভারত আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সঙ্গে মিনারেল সিকিউরিটি পার্টনারশিপ (MSP) এবং কোয়াড ক্রিটিকাল মিনারেল ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করছে, যাতে চীনের উপর নির্ভরতা কমানো যায়।

তবে, এই সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরিবেশ সুরক্ষা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশগত ভঙ্গুরতা এবং জৈববৈচিত্র্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে খনন কার্যক্রম পরিচালনায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এই অঞ্চল সত্যিই ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে একটি সোনার খনি হয়ে উঠতে পারে।