বিহারের রাজনীতি এখন এক ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। মহাগঠবন্ধন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে তাদের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী, তরুণ নেতা তেজস্বী যাদব। ৩৫ বছর বয়সী এই রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) নেতা ও লালু প্রসাদ যাদবের পুত্র এখন প্রতীক নবযুগের আকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তনের প্রত্যয় এবং ‘বিহারি আস্মিতা’র পুনর্জাগরণের। বহু দশক ধরে প্রবীণ নেতৃত্বের দখলে থাকা রাজ্য রাজনীতিতে তেজস্বীর উত্থান যেন এক প্রজন্মান্তরের ধ্বনি।
নতুন প্রজন্মের ভাষা: ‘আমি বিহারি’ থেকে ‘আমি গর্বিত বিহারি’
তেজস্বীর রাজনৈতিক যাত্রা ধীরে ধীরে, কিন্তু সুচিন্তিতভাবে গড়ে উঠেছে। একসময় যাকে ‘লালুর ছেলে’ বলেই তাচ্ছিল্য করা হত, আজ তিনিই হয়ে উঠেছেন বিহারের তরুণ সমাজের মুখ। ২০২০ সালের নির্বাচনে তাঁর প্রতিশ্রুতি, দশ লক্ষ সরকারি চাকরি, একপ্রকার রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। এবার তাঁর স্লোগান আরও স্পষ্ট, আরও আত্মবিশ্বাসী, “আমি বিহারি, আমি ভয় পাই না।”
তেজস্বী এই নির্বাচনে বিহারি পরিচয়কে রাজনীতির কেন্দ্রে এনেছেন। তিনি বলছেন, “বছরের পর বছর ধরে বিহারকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এবার সেই মানচিত্র বদলানোর সময় এসেছে।” তাঁর কাছে ‘বিহারি’ মানে পরিশ্রমী, আত্মগর্বী, মর্যাদাবান এক সমাজ।
মহাগঠবন্ধনের কৌশল: মুখ আছে, বার্তা স্পষ্ট Tejashwi Yadav CM Candidate
পূর্ববর্তী নির্বাচনে নেতৃত্বের অস্পষ্টতা ছিল বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা। এবার মহাগঠবন্ধন সেই শূন্যতা পূরণ করেছে তেজস্বীকে সামনে রেখে। বিজেপি যেখানে এখনো মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করেনি, সেখানে এই সিদ্ধান্ত কার্যত এক স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা, এই নির্বাচনে লড়াই হচ্ছে ‘দিল্লির মোদী’ বনাম ‘বিহারের তেজস্বী’-র মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক সচেতন কৌশল। কারণ তেজস্বীকে সামনে এনে মহাগঠবন্ধন শুধু নেতৃত্বের সংকট মেটায়নি, বরং নির্বাচনের কেন্দ্রে এনেছে প্রজন্মগত ও মানসিক এক সংঘাত—জাতীয় নেতৃত্বের আকর্ষণ বনাম স্থানীয় পরিচয়ের গর্ব।
মোদী ম্যাজিক: এখনও কি অপরাজেয়?
২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক অনিবার্য শক্তি। তাঁর জনসভা মানেই বিপুল জনসমাগম, তাঁর বক্তৃতা মানেই আবেগের জোয়ার। বিহারেও ২০২০ সালের নির্বাচনে তাঁর জনপ্রিয়তা এনডিএ-কে এগিয়ে দিয়েছিল, যদিও মুখ ছিলেন নীতীশ কুমার। বিজেপি তখন ৭৪টি আসন জেতে, যেখানে জেডিইউ পায় মাত্র ৪৩।
তবে এবার প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলেছে। নীতীশের ক্রমাগত শিবিরবদল তাঁকে রাজনৈতিকভাবে অবিশ্বস্ত করে তুলেছে। রাজ্যে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, গ্রামীণ দারিদ্র ও প্রশাসনিক ক্লান্তি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জমে আছে। ‘মোদী গ্যারান্টি’ এখনও প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার সামনে এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জ—স্থানীয় অসন্তোষ ও এক আত্মবিশ্বাসী, তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান।
বিজেপির প্রচাররেখা: উন্নয়নের ধার বনাম ‘জঙ্গল রাজ’ স্মৃতি
বিজেপির প্রচারের মন্ত্র স্পষ্ট—স্থিতিশীল সরকার, শক্তিশালী নেতৃত্ব, এবং কেন্দ্রের উন্নয়ন প্রকল্প। বিনামূল্যে রেশন, আবাসন, স্বাস্থ্যসুবিধা—সবকিছুর পেছনে তুলে ধরা হচ্ছে ‘মোদী মডেল’। তবে একই সঙ্গে ফের উত্থাপন করা হচ্ছে লালু যুগের অরাজকতার স্মৃতি, ‘বিহার যেন ফের না যায় জঙ্গল রাজে।’ তবে নীতীশের অনুপস্থিতিতে বিজেপির সামনে এক দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ-একদিকে নিজস্ব নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করা, অন্যদিকে কুর্মি-কৈরী (ওবিসি) ভোটব্যাংক ধরে রাখা।
প্রজন্মের লড়াই, নাকি রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত?
বিহারের ২০২৫ নির্বাচন শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, এ এক আদর্শগত ও মানসিক রূপান্তরের পরীক্ষাও।
মোদীর রাজনীতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ‘টপ-ডাউন’, জাতীয় গর্বের আকাশ থেকে উন্নয়নের বৃষ্টিধারা নামানোর চেষ্টা।
অন্যদিকে তেজস্বীর রাজনীতি মাটির কাছাকাছি, ‘বিহারি পরিচয়’, মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তায় গড়া ‘বটম-আপ’ মডেল।
একদিকে মোদীর ভারতের গর্ব, অন্যদিকে তেজস্বীর বিহারের আত্মসম্মান। একদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতার চৌম্বকীয় ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে এক তরুণ প্রজন্মের গর্জন, “আমাদের সময় এসেছে।”
শেষ কথা
২০২৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচন তাই কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং এক প্রজন্মান্তরের পর্যালোচনা—কোন ভাবনা জিতবে? মোদীর ‘স্টার পাওয়ার’, না তেজস্বীর ‘বিহারি আত্মবিশ্বাস’? একদিকে দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অমিত শক্তি, অন্যদিকে বিহারের মাটিতে জন্ম নেওয়া নবজাগরণের দাবি। ফল যা-ই হোক, এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে বিহারের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভাষা বদলে দেবে।


