রাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের তীব্র উত্তাপ। সপ্তাহ খানেক আগেই ১৪ বছরের সরকার পরিচালনার খতিয়ান সামনে এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “পাঁচালি” নামে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে তৃণমূল সরকার দাবি করেছিল— প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, সামাজিক উন্নয়ন, পরিকাঠামো বিস্তার, স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা— সব দিকেই গত এক দশকেরও বেশি সময়ে রাজ্য নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে। একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির মাধ্যমে নাগরিকদের যেসব আবেদন জমা পড়েছে, আগামী দু’মাসের মধ্যেই তার বেশিরভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। ফলে রাজ্যজুড়ে শাসক শিবিরে এক আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
তবে সোমবার সেই উৎসাহে জল ঢাললেন রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) । এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি শাসক শিবিরের এই রিপোর্টকে তীব্র আক্রমণ করেন। শুভেন্দুর দাবি— “১৪ বছর ধরে যে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা মানুষ ভোগ করেছেন, সেই ইতিহাসকেই নান্দনিক প্যাকেজিং করে ‘পাঁচালি’ নাম দেওয়া হয়েছে। আসলে এটা উন্নয়ন নয়, হতশ্রী দশারই সারসংক্ষেপ।”
বিরোধী দলনেতা অভিযোগ করেন, মুখ্যমন্ত্রী যে উন্নয়নের ছবি দেখাচ্ছেন, তা বাস্তবের সঙ্গে বেমানান। তাঁর কথায়, “গ্রামের পর গ্রামে মানুষ পানীয় জলের সমস্যা, কর্মসংস্থানের সংকট, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অনিয়মিত সরকারি পরিষেবার সঙ্গে প্রতিদিন লড়ছেন। স্কুল থেকে বিডিও অফিস— বহু জায়গায় অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জোরালো। সেই বাস্তবকে ঢাকতেই এই ‘পাঁচালি’ তৈরি করা হয়েছে।”
শুধু তাই নয়, শুভেন্দু দাবি করেন, রাজ্যের সাধারণ মানুষ আজ ‘তীব্র প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতা’-র মধ্যে আছেন। তাঁর কথায়, “যে সরকার মানুষের আস্থা হারিয়েছে, সেখানে রিপোর্ট প্রকাশ করে বিশ্বাস ফেরানো যাবে না। মানুষের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে, সেটাই মুখ্যমন্ত্রীর বুঝে নেওয়া উচিত।” বিজেপি নেতা আরও অভিযোগ করেন, ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ কর্মসূচিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে। তাঁর বক্তব্য, “এই কর্মসূচির নাম করে এলাকায় এলাকায় শাসকদলের নেতারা নিজেদের প্রচার চালাচ্ছেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঢিলেমি, অনিয়ম এবং স্বজনপোষণ।” এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকে শুভেন্দু বিশেষভাবে সতর্ক করলেন রাজ্যের ঠিকাদারদের। তাঁর বার্তা, “এই ফাঁদে পা দেবেন না। ভোটের মুখে সরকারের তড়িঘড়ি প্রকল্পগুলোতে জড়ালে পরবর্তীতে আইনি সমস্যায় পড়তে হতে পারে। অনেকে উন্নয়নের নামে বরাদ্দ টাকার অপচয়ে জড়াতে পারেন— তাই সাবধান থাকাই ভালো।” তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্যের বিভিন্ন দফতরে বহু প্রকল্পের হিসাব-নিকাশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলনেতার দাবি, “নতুন করে বড় প্রকল্প ঘোষণা করা হলেও অর্থ ছাড় বা প্রকৃত বাস্তবায়ন— দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে গুরুতর অসঙ্গতি। ঠিকাদারদের উচিত নিরপেক্ষভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করা, রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা।”
শুভেন্দুর দাবি, রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন প্রকল্পের রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা মানেই উন্নয়ন হয়েছে— এ ধারণা ভুল। তিনি তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তারা কাগজে-কলমে প্রকল্প দেখিয়ে বাস্তবে মানুষের হাতে খুব কম কাজ পৌঁছে দিতে পেরেছে। তাঁর ভাষায়, “দু’মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করা হবে— এটা বড় প্রতিশ্রুতি। কিন্তু পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা বলছে, অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিই সময় মতো বাস্তবায়িত হয় না।”
তবে শাসক শিবির অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগকে অস্বীকার করেছে। তৃণমূল নেতারা দাবি করেছেন, শুভেন্দুর বক্তব্য শুধুই রাজনৈতিক বিরোধিতার জায়গা থেকে দেওয়া। তাঁদের মতে, সরকার গত ১৪ বছরে গ্রামীণ উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, কৃষি সহায়তা, মহিলা সুরক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে। “পাঁচালি” তারই দলিল।

