এসএসসি কাণ্ডে সরকারকে স্বস্তি দিয়ে চাঞ্চল্যকর রায় সুপ্রিম কোর্টের

ssc scam supreme court

সুপ্রিম কোর্ট মঙ্গলবার একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে কলকাতা হাইকোর্টের একটি নির্দেশ বাতিল করেছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি (ssc) শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে শিক্ষকদের সমন্বয়ের বিষয়ে সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল। এই রায়ের ফলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের পথে একটি বড় বাধা দূর হয়েছে, যদিও এই কেলেঙ্কারির মূল বিষয়গুলি এখনও সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে।

Advertisements

২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ, বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং মোহাম্মদ শব্বর রশিদির নেতৃত্বে, ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর নিয়োগ বাতিল করে।

আদালত জানিয়েছিল

আদালত জানিয়েছিল যে, এই নিয়োগ (ssc) প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে। ওএমআর শিটে কারচুপি, প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও নিয়োগ এবং অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছিল। এই রায়ে হাইকোর্ট আরও নির্দেশ দিয়েছিল যে, সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে অবৈধভাবে নিযুক্তদের সমন্বয় করার সিদ্ধান্তে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে সিবিআই তদন্ত করবে।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবেদনের শুনানি করে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, হাইকোর্ট পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে এবং সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির বিষয়ে তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বাতিল করে, তবে পুরো নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখে।

কেলেঙ্কারির (ssc) পটভূমি

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (ডব্লিউবিএসএসসি) রাজ্যের সরকারি ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের জন্য স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) পরিচালনা করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২৩ লক্ষ প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযোগ ওঠে যে, অনেক প্রার্থী ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন।

ওএমআর শিটে কারচুপি, মেধাতালিকায় অযোগ্যদের স্থান দেওয়া এবং প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগের মতো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এই কেলেঙ্কারি ‘ক্যাশ-ফর-জবস’ নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। তদন্তে নামে সিবিআই এবং ইডি, গ্রেফতার হন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ একাধিক কর্মকর্তা।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, “রাজ্য মন্ত্রিসভা জেনেশুনে জালিয়াতিপূর্ণ নিয়োগকে (ssc) সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” এই পদগুলি অবৈধভাবে নিযুক্তদের চাকরি বাঁচাতে তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। হাইকোর্টের মতে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, যা সিবিআই তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ করা প্রয়োজন।

Advertisements

উজবেকিস্তানের হোটেল থেকে মেঘালয়ের সচিবের মৃতদেহ উদ্ধার! খুন?

সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত

সুপ্রিম কোর্ট মঙ্গলবার জানিয়েছে, “আমরা হাইকোর্টের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বাতিল করছি। এই বিষয়ে রাজ্য সরকারকে তাদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী।” তবে আদালত এও স্পষ্ট করেছে যে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। প্রধান বিচারপতি বলেন, “ওএমআর শিট ধ্বংস করা হয়েছে, প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—এটি একটি সুস্পষ্ট জালিয়াতি। তবে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির বিষয়ে তদন্তের জন্য আরও প্রমাণ প্রয়োজন।”

রাজ্য সরকারের আইনজীবী যুক্তি দেন, “সিবিআই তদন্তের রিপোর্টে মাত্র ৪,৩২৭ জনের নিয়োগে অনিয়ম পাওয়া গেছে। পুরো ২৫,৭৫৩ জনের নিয়োগ বাতিল করা এবং সুপারনিউমারারি পদ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ অযৌক্তিক।” সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তির কিছু অংশ গ্রহণ করে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ স্থগিত করেছে।

প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

এই রায়ে রাজ্য সরকার কিছুটা স্বস্তি পেলেও, বিরোধী দল বিজেপি এটিকে ‘অপরাধীদের রক্ষা করার প্রয়াস’ বলে সমালোচনা করেছে। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও, কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্তদের শাস্তি থেকে বাঁচানো যাবে না।” অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র দাবি করেন, “এটি প্রমাণ করে যে হাইকোর্টের রায় একপেশে ছিল।”

শিক্ষকদের একাংশ, যাদের চাকরি বাতিল হয়েছে, এই রায়ে হতাশ। একজন শিক্ষক বলেন, “আমরা নিরপরাধ, তবু আমাদের চাকরি গেল। সরকার ও কমিশনের ভুলের জন্য আমরা কেন শাস্তি পাব?” অন্যদিকে, যারা নিয়োগের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, তারা নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার আশা করছেন।

ভবিষ্যৎ পথ

সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে যে, রাজ্যকে তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তবে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির বিষয়টি এখনও আইনি ঝুলন্তিতে রয়েছে। এই কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে, এবং এর সমাধান এখনও দূরে।