বীরভূম: পাঁচ মাসের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে অবশেষে নিজের মাটি, নিজের ভিটেতে ফিরলেন বীরভূমের সোনালি বিবি (Sonali Bibi return pushback controversy)। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’, তারপর কয়েক মাসের জেলযাত্রা এই অমানবিক ঘটনার শেষে শুক্রবার সন্ধে ৬টা ৫০-এ মালদার মেহদিপুর সীমান্ত দিয়ে যখন তাঁকে এবং তাঁর আট বছরের ছেলেকে ফিরিয়ে আনা হল, তখন যেন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল গোটা রাজ্যই। সীমান্তের লোহার গেট খুলে যাওয়ার মুহূর্তটি যেন শুধু একটি পরিবার নয়, বারবার পরিচয়–রাজনীতির শিকার হওয়া বহু মানুষের জন্যই আশার বার্তা হয়ে উঠল।
পরিবারের কাছ থেকে প্রথম কথাতেই স্পষ্ট সোনালি বিবির জন্য লড়াই ছিল একেবারে প্রাণপণ। তাঁর বাবা দিন-রাত এক করে আদালতের দোরে দোরে ছুটেছেন। বারবার অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ফেরানোর ক্ষেত্রে ‘টালবাহানা’ চলছে বলে। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে যখন সীমান্তে মেয়েকে ফিরে পেলেন, তাঁর চোখে জল আর কন্ঠে থরথরানি “এই দিনটা দেখব ভাবিনি।”
MotoSoul 2025-এ উন্মোচিত TVS Ronin Agonda সহ একাধিক বাইক
ঘটনার সূত্রপাত দিল্লিতে। অভিযোগ, শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলায় সোনালি, তাঁর ছেলে এবং একইসঙ্গে আরও কয়েকজনকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দিল্লি পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। এরপর কেন্দ্রীয় সংস্থার সিদ্ধান্তে তাঁদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়।
অথচ সোনালির হাতে ছিল জন্মসনদ-সহ যাবতীয় পরিচয়পত্র, যা তাঁকে ভারতের নাগরিক হিসেবেই প্রমাণ করে। তবুও ২৬ তারিখ তাঁকে ও অন্যদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এই মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
পরবর্তীতে বীরভূমের আরও এক মহিলা মুরারইয়ের সুইটি বিবি ও তাঁর দুই ছেলেকেও একইভাবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ও আইনি লড়াই আরও তীব্র হয়। ঘটনা কলকাতা হাইকোর্টে পৌঁছাতেই বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রত মিত্রর ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট নির্দেশ দেয় সোনালি-সহ ছয় জনকে চার সপ্তাহের মধ্যে ফেরাতে হবে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশের পরও ফেরানো হচ্ছিল না। উল্টে মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সময় চায়।
সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্তর বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেন যদি তাঁরা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে প্রমাণিত হন, তবে ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। কিন্তু যেহেতু নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি সামনে এসেছে, তাই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে তাঁদের ফেরানোর নির্দেশ দেওয়া উচিত। আদালতের এই মন্তব্যের পরই ফেরানোর পথ খুলতে শুরু হয়।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় বিতর্ক। তৃণমূল সূত্রে খবর, সোনালিদের ফেরানোকে “পশ্চিমবঙ্গের জয়” বলে মত প্রকাশ করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, “রাজ্যের মানুষের উপর দিল্লির জমিদারদের অত্যাচারের কাছে আমরা মাথা নত করিনি।” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “বিজেপি যাঁদের বেআইনিভাবে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তাঁদের সকলকে ফেরানোর জন্য লড়াই চলবে।”
তাঁর সঙ্গে সোনালি বিবির দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানানো হয়েছে তৃণমূল সূত্রে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে SIR এর আবহে রাজ্যে যখন বহু মানুষের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক, সন্দেহ আর আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তখন সোনালি বিবির দেশে প্রত্যাবর্তন প্রমাণ করে দিল নাগরিকত্ব মানে শুধু নথিপত্র নয় লড়াই, আইনি ন্যায় এবং মানবিকতার জায়গাটিও গুরুত্বপূর্ণ।
পাঁচ মাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতার পর ভারতের মাটিতে পা রাখতেই সোনালি কেবলমাত্র বললেন “আমার ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরে বাঁচলাম।” তবে তাঁর যন্ত্রণা, অপমান ও দীর্ঘ দুশ্চিন্তা এই ঘটনাকে আরও বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় একজন ভারতীয় নাগরিককে শুধু ভাষার ভিত্তিতে ‘অন্য দেশীয়’ তকমা দেওয়া কি কখনও মেনে নেওয়া যায়? এই মুহূর্তে সোনালি বিবির ঘরে আলো জ্বলেছে। কিন্তু পরিচয় নিয়ে অনিশ্চয়তার আবহে লড়াই যে শেষ হয়নি তা বলাই যায়।


