PM Modi vs Mamata: ২০২৬ ভোটের আগে বাংলায় বিজেপির বহুরূপী রণকৌশল

pm-modi-vs-mamata-bjp-kaleidoscopic-strategy-for-bengal-2026

কলকাতা: ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আকাশ আবারও রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিহার নির্বাচনের পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্পষ্ট করে দিয়েছেন বাংলাই বিজেপির পরবর্তী বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্র। তাঁর কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাজনৈতিক বার্তা  “বিহারের গঙ্গা যেমন বহে, তার স্রোত বাংলার রাজনীতিকেও ছুঁয়ে যায়।”

Advertisements

এই ঘোষণার মধ্যেই প্রকাশ পায় বিজেপির মূলমন্ত্র—নির্বাচনী যন্ত্র কখনও থেমে থাকে না

একটি নির্বাচন শেষ মানেই পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু। রাজনৈতিক উত্তাপ তাই এখন থেকেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

   

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৫ বছরের শাসন, চ্যালেঞ্জ ও অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি

২০১১ সালে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ‘স্ট্রিট ফাইটার’ হিসেবে। তাঁর ‘মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগান আজও বাংলার রাজনৈতিক চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত। কিন্তু ২০২৬-এর লড়াই ভিন্ন। একদিকে রয়েছে ১৫ বছরের অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি, অন্যদিকে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, শিল্পহীনতা ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ।

২০২৩ সালের আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণ চিকিৎসকের গণধর্ষণ ও হত্যা রাজ্য রাজনীতিতে ভূমিকম্প ঘটায়। জনগণের ক্ষোভ, রাস্তার বিক্ষোভ, সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপতা—সব মিলিয়ে মমতার জয়ের পথ ২০২৬-এ কঠিন হতে চলেছে।

অর্থনৈতিক সূচকও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। তামিলনাড়ু, গুজরাত, কর্ণাটক কিংবা মহারাষ্ট্রের তুলনায় বাংলার বৃদ্ধির হার পিছিয়ে রয়েছে। শিল্পের পরিকাঠামো দুর্বল, বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম এখন আরও জটিল।

বিজেপির প্রস্তুতি: ছয় জোনে বিভক্ত বাংলা, ‘ক্র্যাক টিম’ মাঠে

২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১—তিন লড়াইয়েই মমতার বিরুদ্ধে বড় জয় পায়নি বিজেপি। কিন্তু সংগঠনগতভাবে তারা এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হাঁটছে।

বিহারের ফলাফল ঘোষণার আগেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট ব্রিগেড’ তৈরি করে ফেলেছিল। ছ’টি জোনে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে আনা হয়েছে ভিন্ন রাজ্যের অভিজ্ঞ সংগঠক, যাতে স্থানীয় দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সংগঠনে শৃঙ্খলা তৈরি করা যায়।

🔶 ১. দার্জিলিং ও পাহাড়: বর্ণনার যুদ্ধক্ষেত্র

  • নেতৃত্বে: প্রদীপ ভাণ্ডারী ও পঙ্কজ কুমার সিং

    উত্তরবঙ্গ বরাবরই বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। পাহাড়ি রাজনীতি, গোর্খাল্যান্ড দাবি ও সীমান্তবর্তী ভূরাজনীতিকে সামনে রেখে বিজেপি এখানে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে।

🔶 ২. রাঢ়বঙ্গ: বিজেপির স্বাভাবিক জনভিত্তি

  • নেতৃত্বে: পবন সাই ও ধন সিং রাওয়াত

    পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান হিন্দিভাষী শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি বেশি। ২০১৯ সালে এখানে বিজেপি দারুণ ফল করেছিল। আবার শক্তি ফিরে পেতে welfare-কেন্দ্রিক প্রচার প্রাধান্য পাবে।

🔶 ৩. হাওড়া-হুগলি-মেদিনীপুর: তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি ভাঙার চেষ্টা

  • নেতৃত্বে: পবন রানা ও সঞ্জয় ভাটিয়া

    এই অঞ্চল অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। ২০২১-এ প্রায় পুরোপুরি তৃণমূল ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মেদিনীপুর ছাড়া বিজেপির হাত শূন্য। এবার কঠোর সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে দল।

🔶 ৪. কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা: আরবান বলয় ভাঙার মিশন

  • নেতৃত্বে: এম সিদ্ধার্থন ও সি টি রবি

    ব্যতিক্রমীভাবে পশ্চিমবঙ্গে শহুরে ভোটাররা তৃণমূলের দিকে বেশি ঝুঁকে। বিজেপি এবার ‘আরবান ইনোভেশন – বুধি ও প্রচার’-এর ওপর জোর দিচ্ছে।

🔶 ৫. নবদ্বীপ ও উত্তর ২৪ পরগনা: সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু মিশ্র এলাকায় নতুন সমীকরণ

  • নেতৃত্বে: এন মধুকর

    বাংলার জনসংখ্যার ভারসাম্যের কারণে এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হলেও বিজেপি মনে করে—এখানে “লুকায়িত সমর্থন” রয়েছে।

🔶 ৬. উত্তরবঙ্গ: জটিলতা ও অনিশ্চয়তার এলাকা

কোচবিহার, মালদা, দিনাজপুরৃ রাজবংশী রাজনৈতিক সমীকরণ ও জাতিগত সংবেদনশীলতা এই অঞ্চলে বিজেপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

নমশূদ্র–মাতুয়া–রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক: বিজেপির বিশেষ ফোকাস

বাংলার ২৩.৫% মানুষই তফশিলি জাতিভুক্ত। এর মধ্যে মাতুয়া, নমশূদ্র, রাজবংশী- রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisements

২০১৯ সালে সিএএ-এর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বিজেপি উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ার বহু এলাকায় শক্ত ভিত তৈরি করে।

মোদীর বাংলাদেশ সফরে ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের মঠে গিয়ে প্রণাম করা ছিল স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।

২০২৬-এর আগে:

  • CAA ক্যাম্প

  • মাতুয়া সমাবেশ

  • সাংস্কৃতিক আউটরিচ

  • SC ভোট সংহত করতে পৃথক অভিযান

এসবই বিজেপির মূল অস্ত্র।

বাংলার রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে যুদ্ধ শুরু

২০২৬-এর লড়াই আর কেবল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, এটি বাঙালির পরিচয়, আবেগ, সংস্কৃতি ও উন্নয়ন স্বপ্নের বহুমাত্রিক সংঘাত।

বিজেপি আগেই বোঝাচ্ছে লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদি, আর তারা এখন থেকেই ময়দানে নেমে পড়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৫ বছরের শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিজেপি এবার আগের চেয়ে বেশি সংগঠিত, বেশি কৌশলী এবং বেশি আক্রমণাত্মক।

বাংলা প্রস্তুত হচ্ছে আরও একটি উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক যুদ্ধে।