কলকাতা, ১৮ নভেম্বর: কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি (পিএম-কিষাণ) যোজনার আওতায় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭০ লক্ষ কৃষক পরিবারের অ্যাকাউন্টে এখনও পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা পৌঁছেছে। বিজেপির অভিযোগ অনুযায়ী কিন্তু এই সুখবরের পিছনে রয়েছে এক বিষাদময় ইতিহাস প্রথম দশ কিস্তির টাকা রাজ্য সরকারের অসহযোগিতার কারণে কৃষকদের হাতে পৌঁছায়নি।
বিজেপি অভিযোগ করেছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দশটি কিস্তি মোট প্রতি কৃষকের জন্য ২০,০০০ টাকা করে কৃষকদের পকেটে আসেনি। এই সময়কালে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় যোজনায় নাম না দিয়ে নিজস্ব ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প চালু করেছিল। ফলস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গই ছিল একমাত-As রাজ্য যেখানে প্রথম দশ কিস্তি পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
হাসিনা ইস্যুতে ধাক্কা বাইশ গজে! বাতিলের পথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ
শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের এপ্রিলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের স্বীকৃতি দিতে রাজি হওয়ার পর থেকে টাকা আসতে শুরু করে। আজ পর্যন্ত ১৮তম কিস্তি পর্যন্ত প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা রাজ্যের কৃষকদের কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু হারানো দশ কিস্তির টাকা আর ফেরত আসেনি।বিজেপির অভিযোগ এই ঘটনা শুধু রাজনৈতিক টানাপোড়েনের নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে পরিচিত সমবায় ব্যবস্থার অবক্ষয়েরও এক করুণ সাক্ষী।
বঙ্গ বিজেপির অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গে একসময় যে প্রাথমিক কৃষি ঋণ সমিতি (PACS) গুলো কৃষকদের বীজ-সার-ঋণের জীবনরেখা ছিল, তার সংখ্যা দ্রুত কমছে। ২০১০ সালে রাজ্যে ৮,০২৬টি পিএসিএস ছিল। ২০২৪ সালের হিসেবে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪,৮৫০টিতে। প্রায় চার হাজার সমিতি গত ১৪ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। কারণ? নির্বাচন না হওয়া, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক উদাসীনতা।
সমবায় আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পিএসিএস-এর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বেশিরভাগ সমিতিতে নির্বাচন হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে সমবায় সমিতিগুলোতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, যেখানে তৃণমূলের লোক নেই, সেখানে নির্বাচন আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে সমিতিগুলোতে বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রশাসক বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রশাসকরা প্রায়শই দলের অনুগত নেতা বা কর্মী। ফলে সাধারণ কৃষক সদস্যদের কোনো কথা বলার জায়গা নেই।এই অবক্ষয়ের ফল ভয়াবহ। একসময় পিএসিএস-গুলো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনত, সার-বীজ সরবরাহ করত, কম সুদে ঋণ দিত।
এখন অনেক সমিতি শুধুই নামমাত্র। কৃষকদের বাধ্য হয়ে মহাজনের কাছে যেতে হচ্ছে। বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের মতো ধানের গোলা বলে পরিচিত জেলাগুলোতে কৃষকরা বলছেন, “আগে সমিতি থেকে ৮-৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যেত, এখন বেসরকারি মহাজন ৩০-৪০ শতাংশ সুদ নিচ্ছে।” কেন্দ্রের পিএম-কিষাণের টাকা এলেও তা দিয়ে বড় খরচ মেটানো যায় না।
সমবায় দফতরের নিজস্ব রিপোর্টই বলছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যের মাত্র ১৮৯টি পিএসিএস-এ নির্বাচন হয়েছে। বাকি হাজার হাজার সমিতি প্রশাসকের হাতে। এই অবস্থাকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘সাংবিধানিক যন্ত্রপাতির সম্পূর্ণ ভাঙন’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “সমবায় হল গ্রামীণ গণতন্ত্রের প্রাণ। সেখানে নির্বাচন বন্ধ করে রাজ্য সরকার গ্রামের কৃষকদের গলা টিপে ধরছে।”
