কলকাতা: রাজনীতির মঞ্চে নতুন এক অদ্ভুত সমীকরণ! তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী যুদ্ধঘোষণার ময়দানে নামছে একদল তরুণ-তরুণী, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক অতীত দেখে অনেকে চোখ কপালে তুলেছেন। কারণ, তৃণমূলের হয়ে ভোটের কৌশল সাজাচ্ছে যে সংস্থা আইপ্যাক (I-PAC), তার দফতরে এখন ভিড় জমিয়েছেন বাম ও বিজেপি নেতারা।
গত কয়েক মাস ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজ্যের কয়েকটি নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে বাছাই করে নিয়োগ করছে আইপ্যাক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP) সক্রিয় নেতাকর্মীদের অনেকেই যেখানে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না, সেখানে এসএফআই (SFI)-এর আগমার্কা মুখরা তরুণীরা আইপ্যাকের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন।
অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৫: রাজ্য সরকারি কর্মীদের বেতন কতটা বাড়তে পারে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন এসএফআই নেত্রী বর্তমানে আইপ্যাকের ‘সেন্ট্রাল লিড’ পদে কর্মরত। তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং যাদবপুরে পড়ার সময় ছিলেন এসএফআই-এর অন্যতম নেত্রী।
শুধু সূচন্দ্রাই নন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্বর্ণাভ রায়, স্বর্ণদীপ্ত রায় এবং তৃষাণ পাল সকলে একসময় বাম ছাত্র রাজনীতির পরিচিত মুখ। এখন তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে নির্বাচনী কৌশল তৈরির দায়িত্বে!
শুধু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নয়, সমাজতত্ত্ব, ইংরেজি, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বহু শিক্ষার্থীও আইপ্যাকে যোগ দিয়েছেন। যাদবপুরের টিএমসিপি-র এক নেতা অভিযোগ করেছেন, “আমরা যারা তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্য, আমাদের অনেকের আবেদনই বাতিল হচ্ছে। অথচ যাঁরা একসময় বাম রাজনীতি করতেন, তাঁদের নিয়েই ভরছে আইপ্যাক।”
আইপ্যাক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য একেবারেই স্পষ্ট। সংস্থার এক শীর্ষকর্তা জানান “আমরা যাদবপুরসহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ করেছি। যোগ্য প্রার্থীদের সিভি দেখে ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় নয়, যোগ্যতাই আমাদের মূল মানদণ্ড।”
তবে বাস্তব চিত্র বলছে অন্য গল্প। আবেদনকারীদের অনেকেই জানিয়েছেন, আইপ্যাকে যোগ দেওয়ার পর তাঁরা তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নিস্ক্রিয় করে দিয়েছেন। ফলে তাঁদের রাজনৈতিক অতীত এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনীতির অন্দরেই শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এক টিএমসিপি নেতা বলেন, “এটা খুব সুসংগঠিতভাবে হচ্ছে। বামেদের অনেকে আইপ্যাকে যোগ দিয়ে ভোট পরিচালনার খুঁটিনাটি শিখছেন। আগামী দিনে এই অভিজ্ঞতা তাঁরা নিজেদের সংগঠনে কাজে লাগাতে পারেন।”
“আমরা শুনেছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসিং হয়েছে এবং অনেকের চাকরি হয়েছে। কিন্তু তাঁরা এখন এসএফআই-এর সঙ্গে যুক্ত, এমন কেউ নেই।” রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা হয়তো প্রজন্মের পরিবর্তনের প্রতিফলন। বর্তমান তরুণেরা রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে কর্মসংস্থান ও পেশাগত অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আবার অন্যদল মনে করছে, এটি তৃণমূলের ভোটযন্ত্রের ভেতরে ‘বিপক্ষের অনুপ্রবেশ’।
“আইপ্যাকের মতো সংস্থাগুলি পেশাদারভাবে কাজ করে। সেখানে রাজনৈতিক রঙ নয়, ডেটা অ্যানালিটিক্স, মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা ও কৌশল প্রণয়নই মুখ্য। তাই এসএফআই বা বিজেপি ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও তারা কাজের দক্ষতা অনুযায়ী নিয়োগ পাচ্ছে।” তবে একই সঙ্গে অনেকেই সতর্ক করেছেন “এটা যদি বামেদের ‘ইনসাইডার’ কৌশল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তৃণমূলের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে।”
তৃণমূলের হয়ে কাজ করছে এমন এক সংস্থার ভেতরে যখন বাম ও বিজেপি-ঘেঁষা তরুণদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তখন রাজনীতির পুরনো বিভাজনরেখা যেন মুছে যাচ্ছে। এটি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক মানসিকতার ইঙ্গিত যেখানে আদর্শ নয়, প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা এবং কর্মক্ষেত্রই মূল মাপকাঠি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে তৃণমূলের ভোটযন্ত্রে ঢুকে পড়া এই ‘বিপক্ষ’ তরুণরা ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলবেন রাজনীতির ময়দানে?