কলকাতা: ২৬ নভেম্বর: যে দিনটিকে দেশজুড়ে সংবিধান দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়, যে দিন নাগরিকরা গণতন্ত্রের চেতনা, অধিকার ও দায়বদ্ধতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হন ঠিক সেই দিনেই পশ্চিমবঙ্গে সামনে এল এক চরম অস্বস্তিকর দৃশ্য। নির্বাচন কমিশন অফ ইন্ডিয়া, যাদের কাজ দেশের ভোটব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখা, তারাই বাধ্য হল কলকাতা পুলিশকে লিখিতভাবে সুরক্ষার আবেদন জানাতে।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। অভিযোগ উঠেছে,ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধন (SIR) নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে শাসক দলের ‘কর্মী’ বলে পরিচিত একদল মানুষ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরে ঢুকে পড়ে, নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে এবং দফতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
৮ম পে কমিশন নিয়ে ফের অসন্তোষ, ToR সংশোধনে নজর কেন্দ্রে
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠিতে স্পষ্ট শব্দে বলা হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে কমিশনের কর্মকর্তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটি এমন এক অবস্থা, যা সরাসরি আঘাত করছে সংবিধানের ৩২৪ থেকে ৩২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনার অধিকার’-এর ওপর।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সংবিধান দিবসের দিনে এই ধরনের ঘটনা শুধুই প্রশাসনিক বিভ্রাট নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশন যে অঙ্গীকারের ভিত্তিতে কাজ করে—সেটি নিরাপদ পরিবেশে ভোটারদের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিজেই রাজ্য পুলিশের কাছে বারবার সুরক্ষার আবেদন জানাতে বাধ্য হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে “গণতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষকই যদি নিরাপদ না হয়, তবে ভোটারদের নিরাপত্তা কোথায়?”
বিরোধীদের অভিযোগ, এ ঘটনা প্রমাণ করে রাজ্য প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ এবং রাজনৈতিক দলের চাপে পঙ্গু হয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা। বিজেপি ও অন্যান্য বিরোধী দল দাবি করছে, তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসবাদীরা SIR প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ফের হিংসা ছড়াতে চাইছে, কারণ ওই প্রক্রিয়ায় ভুয়ো ভোটার, ডুপ্লিকেট এন্ট্রি এবং বেশ কিছু ‘সন্দেহজনক পরিচয়’-এর নাম বাদ পড়তে পারে।
তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, SIR–কে কেন্দ্র করে কিছু “অপ্রীতিকর পরিস্থিতি” তৈরি হলেও সেটিকে রাজনৈতিক রং দিয়ে অযথা বড় করা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাস্থলের ফুটেজ, সরকারি চিঠির ভাষা এবং মুখ্য নির্বাচন দফতরের চারপাশে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যে সাধারণ নয় তা একপ্রকার স্পষ্ট।
সংবিধান দিবসের তাৎপর্য হল গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে স্মরণ করা এবং রক্ষা করার অঙ্গীকার করা। কিন্তু একই দিনে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক সংস্থা যখন চাপের মুখে পড়ে, তখন তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং সংবিধানের আদর্শের প্রতি ব্যঙ্গ বলে মনে করছেন অনেকে। একজন সিনিয়র বিশ্লেষকের মন্তব্য, “ECI-এর কাজ দেশের ভোটব্যবস্থাকে রক্ষা করা। তাঁদের দায়িত্ব ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু যদি কমিশনকেই ভয়ের পরিবেশে কাজ করতে হয়, তবে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে বজায় থাকবে?”
এই মুহূর্তে কমিশন পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে বারবার যোগাযোগ করছে। তবে রাজনৈতিক উত্তেজনা, পরস্পরবিরোধী অভিযোগ এবং রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে চলমান বিতর্কের কারণে প্রশ্ন আরও জট খুলছে। ভবিষ্যতে SIR প্রক্রিয়া ও পরবর্তী ভোটে কী প্রভাব পড়বে—তা এখনই বলা কঠিন, তবে সংবিধান দিবসে যে বার্তা রাজ্যের মানুষ পেয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
