গুয়াহাটি, ২৪ নভেম্বরঃ অসম বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে। মাত্র পাঁচ দিনের এই সংক্ষিপ্ত অধিবেশনকে ঘিরে ইতিমধ্যেই দিসপুরের রাজনৈতিক পরিবেশ চরম উত্তেজনায় ফেটে পড়েছে। এবারের অধিবেশনে উত্থাপিত হতে চলা বিলের সংখ্যা নেহাত কম নয় কমপক্ষে ২৬টি বিল উত্থাপিত হতে পারে বলে বিধানসভার প্রধান সচিব দুলাল পেগু জানিয়েছেন।
এর মধ্যে পাঁচটি সম্পূর্ণ নতুন বিল এবং বাকিগুলি সংশোধনী বিল। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন—সরকার কি অতিরিক্ত তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল দ্রুত পাশ করাতে চাইছে? নাকি এই সংকুচিত সময়সীমা দিয়ে বিরোধীদলকে বিতর্কের সুযোগ কমিয়ে রাখতে চাইছে? এবারের অধিবেশনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক ইস্যু নিঃসন্দেহে নেলী গণহত্যা।
চূড়ান্ত হয়নি আইএসএলের দিনক্ষণ, ফিটনেস বজায় রাখতে মরিয়া রবসন থেকে রদ্রিগেজরা
১৯৮৩ সালের সেই বিভীষিকার স্মৃতি আজও অসমের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে গভীর দাগ কেটে রয়েছে। বহু বছর ধরে অপেক্ষার পর তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট এবার সদনে পেশ হতে পারে বলে শোনা মাত্রই রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
শাসকদল এই রিপোর্ট প্রকাশকে ইতিহাসের সত্য সামনে আনার দায়িত্ব বলে দাবি করছে, আর বিরোধীদল বলছে—আসন্ন রাজনৈতিক সময়কে সামনে রেখে সরকার এই রিপোর্টকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। নেলী রিপোর্ট যদি সত্যিই এই অধিবেশনে পেশ হয়, তবে রাজ্যের রাজনৈতিক বৃত্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, তা নিশ্চিত।
অধিবেশন শুরুর আগেই সংসদীয় পরিক্রমা দপ্তরের মন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারির ডাকে অনুষ্ঠিত হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সর্বদলীয় বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত শাসক এবং বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা স্পষ্ট জানান—এতসংখ্যক বিল এবং এত বড় বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু পাঁচ দিনের মধ্যে কোনোভাবেই সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। বিলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা সময়ও বাড়ানোর দাবি জোরালো হয়। ফলে অধিবেশনের সময়সীমা ১–২ দিন বাড়তে পারে বলে বৈঠকের পর রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে।
বৈঠক শেষে বিধায়ক দুর্গাদাস বড়ুয়া মন্তব্য করেন যে, এবার বহু গুরুতর বিল রয়েছে এবং প্রতিটি বিল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া প্রয়াত শিল্পী জুবিন গার্গের মৃত্যু প্রসঙ্গেও প্রতিটি সদস্য বক্তব্য রাখার জন্য সময় চেয়েছেন। তাঁর কথায়, জনগণ যাকে এত ভালোবাসতেন সেই শিল্পীর মৃত্যু নিয়ে সদনেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠবেই। বিধায়ক মনোরঞ্জন তালুকদার বৈঠকের পর আরো স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, সরকার এখনো বিলের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেনি।
তালিকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আলোচনার গতি নির্ধারণ করা কঠিন। তবে তিনি স্পষ্ট বলেন—জুবিন গার্গের মৃত্যু ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, এবং এই বিষয়টি যে অধিবেশনকে আরও উত্তপ্ত করবে, তাও নিশ্চিত। বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকীয়া আরও আক্রমণাত্মক সুরে বলেন, তাঁরা ১০ দিনের অধিবেশন দাবি করেছিলেন, কারণ আলোচনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগণিত। শিক্ষা সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধির জ্বালা, বিদেশি অনুপ্রবেশ, নাগরিকত্ব যাচাই, দুর্নীতি—এই সমস্ত বিষয়ের কথা মাথায় রেখে তারা দীর্ঘ অধিবেশনের দাবি তুলেছিলেন।
কিন্তু সরকার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে সবকিছু শেষ করতে চাইছে, যা বাস্তবসম্মত নয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই আলোচনা চাপা দিতে সরকারের এই মনোভাব স্পষ্ট। জুবিন গার্গের মৃত্যু এবারের অধিবেশনের আবেগপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে। সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা রহস্য, তদন্তের প্রশ্ন, প্রশাসনিক ভূমিকা—সব মিলিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ জমেছে, তা সদনেও বিস্ফোরিত হবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্বাস।
বিরোধীরা মনে করছে, জুবিন গার্গের মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত, এবং সেগুলি সদনে তুলতেই হবে। শাসকদলও জানিয়েছে—সরকার তদন্তকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে, এবং প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু জনমত যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে এই ইস্যু যে অধিবেশনের অন্যতম সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হবে, তা সবারই অনুমেয়। বিদেশি সমস্যা এবং নাগরিকত্ব যাচাই সংক্রান্ত বিতর্ক এবারের অধিবেশনকে আরও জটিল করে তুলবে, তা নিশ্চিত।
এন আর সি , এস আর এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক সংঘাত তৈরি হয়েছে, তার প্রতিধ্বনি এই শীতকালীন অধিবেশনেও তীব্রভাবে শোনা যাবে। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে। বাজারে সবজির দাম, ডিমের দাম, খাদ্যসামগ্রীর ব্যয় সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ তীব্র। বিরোধীরা দাবি করছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এবং এই বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন সদনে তোলা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতি এবং জনজীবনের চাপ এবারের বিতর্কের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠতে পারে। এই সবকিছুর মাঝে সরকার স্পষ্ট করেছে এবারের বিধানসভা অধিবেশনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তারা কোনো খামতি রাখতে নারাজ। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও প্রশাসন নজিরবিহীন উদ্যোগ নিয়েছে। দিসপুর বিধানসভা চত্বরে একাধিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত বাহিনী, তদারকি জোরদার করা হয়েছে ড্রোন ও অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে।
প্রশাসনের মতে, রাজনৈতিক তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতির কারণে সামান্য অসাবধানতাও বড় ধরনের অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া হবে না। স্বল্প সময়ের হলেও এবারের শীতকালীন অধিবেশন যে রাজনৈতিকভাবে বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত অধ্যায় হয়ে উঠতে চলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিলের পাহাড়, নেলী গণহত্যার রিপোর্ট, বিদেশি সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, এবং প্রয়াত শিল্পী জুবিন গার্গের মৃত্যু—সব মিলিয়ে পাঁচ দিনের এই অধিবেশন বহুমাত্রিক বিতর্ক, আবেগ এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষে ভরপুর হতে চলেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দিসপুরের করিডর জুড়ে যে অগ্নিগর্ভ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী পাঁচ দিন গোটা রাজ্যের নজর বিধানসভাতেই আটকে থাকবে।
