পটনা: বিহারের মাটিতে ফের রাজনৈতিক অপরাধে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। মোকামার প্রভাবশালী নেতা ও স্বঘোষিত ‘ছোটে সরকার’ অনন্ত কুমার সিং এবার গ্রেফতার হয়েছেন দুলারচাঁদ যাদব হত্যাকাণ্ডে। এই ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় রাজ্য রাজনীতিতে। একসময়ের জনপ্রিয় জননেতা, আবার অপরাধ জগতের নাম দুই পরিচয়ের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছেন অনন্ত সিং।
মোকামা, যা পাটনা থেকে একশ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত, প্রায় দুই দশক ধরে অনন্ত সিং-এর রাজত্বের প্রতীক। সাদা পোশাক, সানগ্লাস আর হঠাৎ করা মন্তব্য এই ভঙ্গিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা প্রায় তারকা-সমান। কিন্তু ঝলমলে এই চেহারার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা।
ট্রাম্পের চোখরাঙানি উড়িয়ে দিয়ে রাশিয়া থেকে তেল কিনল IOCL
নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র অনুযায়ী, অনন্ত সিং-এর বিরুদ্ধে বর্তমানে ২৮টি ফৌজদারি মামলা চলছে। তার মধ্যে খুন, অপহরণ, ষড়যন্ত্র, আঘাত, ও অস্ত্র আইনের মামলাও রয়েছে। তিনি নিজেই একাধিকবার বলেছেন, “মোকামায় আমিই আইন।”
অর্থনৈতিক দিক থেকেও তিনি কম শক্তিশালী নন। হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ₹৩৭.৮৮ কোটি। তাঁর রয়েছে দুইটি বিলাসবহুল গাড়ি—টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ও ফরচুনার SUV, এমনকি একটি হাতি, ঘোড়া এবং গবাদি পশুও তাঁর মালিকানায়। তাঁর স্ত্রী নীলম দেবী, বর্তমানে আরজেডির বিধায়ক, যাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ₹৬২.৭২ কোটি টাকা।
২০০৫ সালে জেডিইউ-এর টিকিটে প্রথমবার বিধানসভায় প্রবেশ করেন অনন্ত সিং। ২০১০-এ ফের জেতেন, কিন্তু ২০১৫-তে নীতীশ কুমার ও লালু যাদবের জোটের পর তিনি দল ছাড়েন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ২০২০ সালে তিনি আরজেডি-তে যোগ দেন এবং আবারও জয় পান।
কিন্তু ২০২২ সালে অস্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ হয়। পরবর্তীতে স্ত্রী নীলম দেবী উপনির্বাচনে জয় পেয়ে আসনটি ধরে রাখেন। এবার অনন্ত সিং ফের ফিরে যান নীতীশ কুমারের জেডিইউ-তে, কিন্তু বিধানসভা ভোটের মুখে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবার অন্ধকারে।
গত বৃহস্পতিবার মোকামা থেকে উদ্ধার হয় দুলারচাঁদ যাদবের মৃতদেহ, যিনি স্থানীয়ভাবে একসময় গ্যাংস্টার হলেও পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যাদব প্রচার অভিযানে ছিলেন, তখনই এক সংঘর্ষে তিনি গুরুতর আহত হন।
ময়নাতদন্তে প্রকাশ, হৃদয় ও ফুসফুসে আঘাতজনিত শকে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় অনন্ত সিং, মানিকান্ত ঠাকুর ও রঞ্জিত রামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অনন্ত সিং অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এটি আমার বিরোধী সুরজ ভানের ষড়যন্ত্র। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”
বিহারের রাজনীতি বহুদিন ধরেই ‘বাহুবলি সংস্কৃতি’র জন্য কুখ্যাত। যেখানে জনপ্রিয়তা ও অপরাধ, দুই-ই হাত ধরাধরি করে চলে। একদিক থেকে অনন্ত সিং-এর মতো নেতারা জনমানসে “রবিন হুড”-এর চেহারা পান, অন্যদিকে তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, অস্ত্র পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “বিহারের রাজনীতিতে অপরাধীরা কেবল প্রভাবশালী নন, তাঁরা প্রায়শই জনপ্রিয়ও।
অনন্ত সিং-এর ঘটনা দেখিয়ে দেয়, গণতন্ত্র ও গ্যাংস্টার রাজনীতির সীমারেখা কতটা মিশে গেছে।” দুলারচাঁদ যাদবের হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ফৌজদারি ঘটনা নয়, বরং বিহারের রাজনীতিতে অপরাধের দীর্ঘ ছায়ার আরেকটি অধ্যায়। এখন দেখার বিষয় ‘ছোটে সরকার’-এর এই অধ্যায় শেষ হয় কিনা, নাকি আবারও তিনি ফিরবেন রাজনীতির মঞ্চে।
