মমতার ক্ষমতার কোপে ‘পদ’ হারানো অধীর কী বেচবেন ‘বাদাম’?

প্রদেশ সভাপতির পদ গেল অধীরের, কিন্তু তাতে নৈতিক জয় মমতার? অনেকেই ভাবতে পারেন দুটো আলাদা দল, তাদের আলাদা আলাদা নেতা। তাহলে কংগ্রেসের অধীরের সভাপতিত্বের পদ…

Adhir Ranjan Chowdhury Mamata Banerjee

প্রদেশ সভাপতির পদ গেল অধীরের, কিন্তু তাতে নৈতিক জয় মমতার? অনেকেই ভাবতে পারেন দুটো আলাদা দল, তাদের আলাদা আলাদা নেতা। তাহলে কংগ্রেসের অধীরের সভাপতিত্বের পদ হাতছাড়া হলে, তৃণমূলের তাতে কী? রাজনীতিবিদদের মতে ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঠান্ডা লড়াই চলে আসছে দুই হেভিওয়েটের। তাঁদের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) এবং অধীর রঞ্জন চৌধুরী (Adhir Ranjan Chowdhury)।

বঙ্গের অনেক পোড়খাওয়া রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে মমতা নয় অঙ্কের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের এখনকার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল বহরমপুরের অধীরেরই। কিন্তু ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যুবনেত্রী মমতা নিজের আলাদা দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করলেন। অধীরের বঙ্গের ক্ষমতার বৃত্ত থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেই শুরু। ধীরে ধীরে সিপিআইএম বিরোধী রাজনীতির পোস্টার-গার্ল হয়ে উঠলেন মমতা। এক সময়কার কংগ্রেস ভেঙে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসই হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল।

   

অবশ্য কংগ্রেসে থাকাকালীন সময় থেকেই অধীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মমতার। বস্তুত রাজ্যে বাম-কংগ্রেস সেটিং এর অভিযোগ তুলেই আলাদা দল তৈরি করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। সংঘাতের সেই শুরু, ২০২৪ সালেও সেই সংঘাতের ধার এবং ভার বিন্দুমাত্র কমেনি বলেই অভিজ্ঞদের অভিমত। অপরদিকে কেন্দ্রের কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যের তৃণমূলের যতই সদ্ভাব থাকুক না কেন, অধীর বরাবরই মমতার বিরোধিতায় অনড়। ২০১১ সালে যদিও কংগ্রেস-তৃণমূল ‘মহাজোট’ রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ তে সেই প্রাক্তন শাসক দল সিপিএমের সঙ্গেই জোট বাঁধে কংগ্রেস।

বস্তুত বঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসী জোটের ঘরানার সেই শুরু। তারপর থেকে মমতা ইস্যুতে কার্যত কংগ্রেসের রাজ্য এবং হাইকম্যান্ডের সংঘাত বরাবরই চোখে পড়েছে। গত লোকসভা ভোটে যা তীব্রতর আকার নিয়েছিল। তৃণমূলের অভিষেক বা মমতার মুখে বারংবার শোনা গিয়েছে দিল্লির কংগ্রেস এবং রাজ্যের কংগ্রেসের কথা। এমনকী অধীরের বহরমপুরকে প্রেস্টিজ ফাইট হিসাবে নিয়েছিলেন মমতা, অভিষেক দুজনেই। ফলাফল – বহরমপুরের দীর্ঘকালের মিথ ভেঙ্গে অধীর দুর্গের পতন।

যদিও অধীর লোকসভায় বঙ্গের ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগপত্র নিজে থেকে জমা দিয়েছেন। কিন্তু অধীরের কথাবার্তায় পরিষ্কার যে, তাঁর মনে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ারই আশাটা বেশি ছিল। কিন্তু দিল্লির বুকে গুলাম নবী আজাদের মুখে ‘প্রাক্তন সভাপতি’ শব্দটা শোনার ধাক্কা কিংবা কল্পনা কোনটাই অধীর আগে থেকে করেননি। আর এর পিছনে বিশেষজ্ঞ মহল দেখতে পাচ্ছেন একটা অন্য সমীকরণ। যে সমীকরণের হিসেবে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া ব্লকের মধ্যে ঘাসফুলের দীর্ঘ ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকে।

খাতায়-কলমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২৯ আসন তৃণমূলের। কিন্তু ইন্ডিয়া ব্লকের মধ্যেই এখন তৃণমূলের নিজস্ব একটা ব্লক তৈরি হয়ে গিয়েছে। যে ব্লকে রয়েছেন উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ, দিল্লির কেজরিওয়াল এবং মহারাষ্ট্রের উদ্ভব। আম্বানির ছেলের বিয়েতে মুম্বাই গিয়ে উদ্ভবের বাড়িতে বিশেষ সাক্ষাৎ এবং আসন্ন মহারাষ্ট্র বিধানসভায় শিবসেনার হয়ে প্রচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে এসেছেন মমতা। আবার একুশে জুলাই এর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উত্তরপ্রদেশ থেকে ছুটে এসেছেন অখিলেশ। এদিকে নীতি আয়োগের বৈঠকে গিয়ে জেলবন্দি কেজরিওয়ালের বাসভবনে তাঁর স্ত্রী সুনীতার সঙ্গেও দীর্ঘক্ষন কথা বলে এসেছেন মমতা।

জাতীয় রাজনীতিতে মমতার এই ‘ম্যান-ম্যানেজমেন্ট’ কিন্তু বেশ ভালোই চাপে রেখেছে কংগ্রেসকে। আগামী দিনেও হয়ত কংগ্রেস একা সরকার গঠন করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মমতা এবং তার বিশেষ বন্ধুদের অবদান যে অবশ্যম্ভাবী তা এখনই বুঝতে পেরেছেন কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড। আর তাই বারংবার অধীরকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা মমতাকে কার্যত তুষ্ট করতে চেয়েছেন দিল্লির নেতারা। এমনটাই দাবি বিশেষজ্ঞদের।

আর সেক্ষেত্রে কী বঙ্গের রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিকই হয়ে পড়লেন একদা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং বহরমপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা? তাঁর পরবর্তীতে কে হবেন সভাপতি? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত পাওয়া যায়নি। কিন্তু আপাতত এটা বোঝা যাচ্ছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনমতেই চটাতে চাইছে না দিল্লির কংগ্রেস। ফলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে মমতাপন্থী কারোরই বসার সম্ভাবনা জোরালো। সেক্ষেত্রে বঙ্গের আরেক কট্টর মমতা বিরোধী মুখপাত্র সৌম্য আইচেরও পদে কাঁচি চালাতে পারে দিল্লি।

কিন্তু এখন প্রশ্ন অধীর রঞ্জন চৌধুরী এরপর কি করবেন। লোকসভা ভোটে তিনি জোর গলায় মমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বহরমপুরে এসে দাঁড়াতে বলেছিলেন। সংবাদ মাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে দাবি করেছিলেন, যদি মমতা বা ইউসুফ পাঠান তাঁকে হারাতে পারে, তিনি রাজনীতি ছেড়ে বাদাম বেচবেন। যদিও তিনি হেরেছেন, কিন্তু বাদামের দোকান এখনও অবধি খুলেছেন কিনা, তা কারোর জানা নেই। এরপর অধীর কী আরেক প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি সৌমেন মিত্রর রাস্তাই অবলম্বন করবেন? ২০০৮ সালের জুলাই মাসেই প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সৌমেন মিত্র কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস নামে নিজের একটা আলাদা দল তৈরি করেন। যদিও সেই দলের অস্তিত্ব এক বছরের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। সৌমেন যোগ দেন মমতার তৃণমূল কংগ্রেসে।

ঘটনাচক্রে যেদিন দিল্লিতে অধীরের এই প্রাক্তন হওয়ার মিটিং ছিল, তারপরের দিনটাই সৌমেন মিত্রের প্রয়াণ দিবস। রাজনীতির এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। অধীর বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ধীরে চলো নীতিই নেবেন? নাকি ২০২৬-এর বিধানসভার কথা ভেবে এখন থেকেই কোন চরম পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তিনি ভাবতে শুরু করছেন? বহরমপুরের প্রাক্তন মুকুটহীন সম্রাটের মনে কোন ঝড় চলছে তা একমাত্র তিনি নিজেই জানেন।

একসময় সংবাদমাধ্যমের সামনেই হাহাকার করে বলেছেন, মমতা তাঁর সব কেড়ে নিয়েছে। এবার সেই মমতার কাছে কার্যত আরও একবার অসহায় ভাবে পরাজয় স্বীকার। কিন্তু খোঁচা খাওয়া বাঘের মত প্রত্যাবর্তন হবে অধীরের, নাকি বঙ্গ রাজনীতির ক্যানভাস থেকে তাঁর নামটা ধীরে ধীরে আবছা হতে থাকবে? আপাতত আগামী দিনের কলকাতা-দিল্লির রাজনীতির সমীকরণেই সেই ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে।