পডকাস্টে দু কোটি ভিউ তবুও মাল্যর দাবি কি আদৌ সত্য ? তথ্য কি বলছে

ভারতে ‘অর্থনৈতিক পলাতক’ ঘোষিত বিজয় মাল্য (vijay-mallya) সম্প্রতি একটি পডকাস্টে ইনফ্লুয়েন্সার রাজ শমানির সঙ্গে চার ঘণ্টার কথোপকথনের মাধ্যমে ২ কোটির বেশি ভিউ অর্জন করেছেন। ১০…

vijay-mallya fact check

ভারতে ‘অর্থনৈতিক পলাতক’ ঘোষিত বিজয় মাল্য (vijay-mallya) সম্প্রতি একটি পডকাস্টে ইনফ্লুয়েন্সার রাজ শমানির সঙ্গে চার ঘণ্টার কথোপকথনের মাধ্যমে ২ কোটির বেশি ভিউ অর্জন করেছেন। ১০ জুন তিনি এক্স-এ টুইট করে বলেন, “আমি নম্র ও অভিভূত বোধ করছি, তবে এটি আমার প্রকৃত অনুভূতির তুলনায় অনেক কম।”

এই পডকাস্ট তার জন্য কেবল একটি মাইলফলক নয়, বরং জনমতকে তার পক্ষে আনার এবং ভারতে তার ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের একটি প্রচেষ্টা। তিনি দাবি করেছেন, তিনি ভারতীয় ব্যাঙ্ক ও সংস্থাগুলির দ্বারা ‘অন্যায়ভাবে’ লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছেন এবং তিনি ঋণের চেয়ে বেশি অর্থ ফেরত দিয়েছেন। তবে তার দাবিগুলো কতটা সত্য? আসুন তথ্য যাচাই করি।

   

দাবি ১: “আমি ৬,২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলাম এবং ১৪,০০০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছি”

তথ্য যাচাই

মাল্যর (vijay-mallya) উল্লেখিত ৬,২০০ কোটি টাকা কেবল কিংফিশার এয়ারলাইন্স এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ১৭টি ব্যাঙ্কের কনসোর্টিয়াম থেকে নেওয়া মূল ঋণের পরিমাণ। কিন্তু ব্যাঙ্কিং নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের উপর সুদ জমা হয় এবং ডিফল্টের ক্ষেত্রে জরিমানা সুদ ও অন্যান্য চার্জ যুক্ত হয়। ২০১৩ সালে কিংফিশার ডিফল্ট করার পর ডেট রিকভারি ট্রাইব্যুনালে (ডিআরটি) মামলা হয়। ডিআরটি’র নির্দেশ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত মূলধন, সুদ এবং জরিমানা মিলিয়ে মোট বকেয়া ছিল ১৭,৭৮১ কোটি টাকা।

এর মধ্যে ১০,৮১৫ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে, তবে এটি মাল্যর (vijay-mallya)স্বেচ্ছায় পরিশোধ নয়। গোয়ার কিংফিশার ভিলা এবং ইউনাইটেড ব্রুয়ারিজের শেয়ারের মতো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আদালতের তত্ত্বাবধানে বিক্রি করা হয়েছে। এই সম্পত্তি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (পিএমএলএ) এর অধীনে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, যখন মাল্যকে অর্থনৈতিক পলাতক ঘোষণা করা হয়।

এখনও ৬,৯৯৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। মাল্যার ১৪,০০০ কোটি টাকা ফেরতের দাবি দুটি কারণে বিভ্রান্তিকর: প্রথমত, এটি জোরপূর্বক উদ্ধারকে স্বেচ্ছায় পরিশোধ বলে উপস্থাপন করে; দ্বিতীয়ত, এটি সুদ এবং জরিমানা চার্জকে উপেক্ষা করে।

দাবি ২: “আমি কোনো প্রতারণা করিনি, আমার উদ্দেশ্য ছিল ঋণ পরিশোধ”

তথ্য যাচাই

মাল্য (vijay-mallya) তার ক্রিয়াকলাপকে ব্যবসায়িক ব্যর্থতার ফল বলে উপস্থাপন করেন। কিন্তু ভারতীয় আইন, বিশেষত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নির্দেশিকা, ব্যবসায়িক ব্যর্থতা এবং ইচ্ছাকৃত ডিফল্টের মধ্যে পার্থক্য করে। মাল্যাকে ব্যাঙ্কগুলো ‘ইচ্ছাকৃত ডিফল্টার’ ঘোষণা করেছে, যার অর্থ তিনি পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা করেননি।

এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকার তহবিল স্থানান্তরের প্রমাণ পেয়েছে, যা কিংফিশারের কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়নি। এই অর্থ ফোর্স ইন্ডিয়া ফর্মুলা ওয়ান টিম এবং ব্যক্তিগত বিলাসবহুল খরচে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে ডায়াজিও থেকে প্রাপ্ত ৪০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৪২ কোটি টাকা) তিনি তার পরিবারের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন, যা ব্যাঙ্কের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত গ্যারান্টি চুক্তির লঙ্ঘন। সুপ্রিম কোর্ট এটিকে অবমাননার কারণে দোষী সাব্যস্ত করে।

দাবি ৩: “আমি ভারত ছাড়ার আগে অরুণ জেটলিকে জানিয়েছিলাম”

তথ্য যাচাই

মাল্যর (vijay-mallya) এই দাবির কোনো সরকারি নথি নেই। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, মাল্য পার্লামেন্টের করিডোরে তার সঙ্গে অঘোষিতভাবে দেখা করেছিলেন এবং সমঝোতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। জেটলি তাকে ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল না। মাল্যর এই দাবি তিনি গোপনে পালাননি বলে প্রমাণ করতে ব্যবহার করেন, কিন্তু এটি কেবল একটি কথোপকথন ছিল।

দাবি ৪: “আমার মামলা ফৌজদারি নয়, এটি ব্যবসায়িক ব্যর্থতা”

তথ্য যাচাই

মাল্যর আইনি সমস্যা কেবল ব্যর্থ এয়ারলাইন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি পিএমএলএ, ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং অন্যান্য আর্থিক নিয়মের অধীনে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি। ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে অবমাননার মামলায় চার মাসের কারাদণ্ড দেয়। এছাড়া, ১০০ কোটি টাকার সার্ভিস ট্যাক্স জমা না দেওয়ার মামলায় তার বিরুদ্ধে অ-জামিনযোগ্য ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের আদালত তার প্রত্যর্পণ অনুমোদন করেছে, যদিও আশ্রয় সংক্রান্ত আপিলের কারণে তা বিলম্বিত হয়েছে।

দাবি ৫: “আমার কোম্পানির সম্পত্তি কম মূল্যে বিক্রি হয়েছে”

তথ্য যাচাই:

Advertisements

মাল্য (vijay-mallya) দাবি করেন, তার সম্পত্তি প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কমে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এটির সমর্থনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। ঋণ নেওয়ার সময় তিনি কিংফিশার এয়ারলাইন্সের মূল্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন, যা তার আর্থিক কর্মক্ষমতার তুলনায় অতিরঞ্জিত ছিল। সম্পত্তি বিক্রি আদালতের তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে, এবং কম দামের কারণ ছিল আইনি জটিলতা এবং ব্র্যান্ডের মূল্যহ্রাস।

দাবি ৬: “আমি কোম্পানির তহবিল অপব্যবহার করিনি”

তথ্য যাচাই:

ইডি’র তদন্তে দেখা গেছে, ২৪১ কোটি টাকা ফোর্স ইন্ডিয়া এফ১ টিমে স্থানান্তরিত হয়েছে। এছাড়া, ১০০ কোটি টাকা ব্যক্তিগত বিমান চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ৩৩০ কোটি টাকার বিদেশি সম্পত্তি কেনা হয়েছে, যখন কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছিলেন না। এই তথ্য তহবিল অপব্যবহারের প্রমাণ দেয়।

দাবি ৭: “আমি কর্মচারীদের বেতন বা বকেয়া অস্বীকার করিনি”

তথ্য যাচাই:

২০১২ সালের মাঝামাঝি থেকে কিংফিশার কর্মচারীদের বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ৩৭১ কোটি টাকার পিএফ এবং কর কর্তন জমা দেওয়া হয়নি। এই সময়ে মাল্য বিলাসবহুল জীবনযাপন অব্যাহত রাখেন, যা তার আর্থিক অক্ষমতার দাবিকে খণ্ডন করে।

দাবি ৮: “প্রণব মুখার্জি ২০০৮ সালে কিংফিশার বন্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন”

সীমান্তে ড্রোন-ড্রামা: যুদ্ধবিরতির মাঝেও মাদক-অস্ত্র পাঠাচ্ছে পাকিস্তান

তথ্য যাচাই:

এই দাবির কোনো সরকারি নথি নেই। প্রণব মুখার্জি আর বেঁচে নেই, তাই এটি যাচাই করা সম্ভব নয়। এমনকি যদি এই পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, তবে এটি মাল্যর (vijay-mallya) আর্থিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয় না।

দাবি ৯ “আমি নিজের তহবিল থেকে ঋণ পরিশোধ করেছি”

তথ্য যাচাই

মাল্য ২০১৬ সালে ভারত ছাড়ার পর কোনো স্বেচ্ছায় পরিশোধের রেকর্ড নেই। উদ্ধারকৃত ১০,৮১৫ কোটি টাকা আদালতের নির্দেশে সম্পত্তি বিক্রি থেকে এসেছে, যা মাল্যার সহযোগিতায় নয়।

দাবি ১০: “মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট”

তথ্য যাচাই

মাল্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ ইডি, সিবিআই এবং সুপ্রিম কোর্টের তথ্যের উপর ভিত্তি করে। ‘অর্থনৈতিক পলাতক’ ঘোষণা ২০১৮ সালের আইনের অধীনে হয়েছে। মিডিয়া কভারেজ জনমত গঠন করতে পারে, কিন্তু তার আইনি সমস্যা নথিভুক্ত লঙ্ঘনের ফল।

বিজয় মাল্যর (vijay-mallya) পডকাস্ট লক্ষ লক্ষ ভিউ পেলেও, জনমানসের সমর্থন বা সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণ তার আইনি ও আর্থিক বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে পারে না। তার দাবিগুলো আদালতের রায়, তদন্ত এবং ব্যাঙ্ক রেকর্ড দ্বারা খণ্ডিত হয়। তিনি ভারতে ফিরতে চান বলে দাবি করলেও, তার দাবিগুলোর সত্যতা এবং আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।