হিমাচল (Himachal) প্রদেশে চলতি বর্ষায় টানা প্রবল বর্ষণ, হঠাৎ মেঘফাটা এবং ভয়াবহ ভূমিধস রাজ্যজুড়ে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ি এই রাজ্যে জুন মাসের ২০ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ পর্যন্ত সময়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার প্রাথমিক হিসাব দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪,১২২ কোটি টাকার সমপরিমাণ। মানুষের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি ধ্বংস, সড়ক ও সেতু ভেঙে যাওয়া, কৃষিজমি তছনছ—সব মিলিয়ে এক গভীর দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে হিমাচলবাসী। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৩৭০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনও ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঙ্গলবার হিমাচল প্রদেশে পৌঁছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আকাশপথে জরিপ করেন। তাঁর হেলিকপ্টার সফরে বিশেষত মান্ডি, কুল্লু এবং চাম্বা জেলার উপর দিয়ে ঘুরে দেখা হয়, যেগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী এক্স-এ (পূর্বতন টুইটার) বার্তায় লিখেছেন— “হিমাচল প্রদেশে বন্যা ও ভূমিধস-পরবর্তী পরিস্থিতি আকাশপথে পর্যালোচনা করলাম। এই কঠিন সময়ে আমরা হিমাচলের মানুষের পাশে আছি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ও প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দিতে সমস্ত রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী মোদী কাংড়া বিমানবন্দরে হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরসহ প্রায় ২০ জন শীর্ষ নেতা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিপর্যয়ের পূর্ণাঙ্গ ছবি উপস্থাপন করা হয় এবং কেন্দ্র সরকারের কাছে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজের অনুরোধ জানানো হয়।
মুখ্যমন্ত্রী সুখু এক সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন— “গত সপ্তাহের টানা বৃষ্টিপাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়েছে, সড়কপথ, পানীয় জলের লাইন এবং বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুলনায় ২০২৩ সালের মতো প্রাণহানি না হলেও, একের পর এক মেঘফাটার ফলে রাজ্যে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এই ঘটনাগুলির কারণ অনুসন্ধান করা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন— “আমরা আশা করছি কেন্দ্র থেকে বিশেষ ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে, যাতে ক্ষতির মাত্রা অনুযায়ী তহবিল বরাদ্দ করা যায়। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে কেন্দ্রীয় সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।”
প্রধানমন্ত্রী মোদী পরিদর্শনকালে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) এবং রাজ্য দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর (এসডিআরএফ) কর্মীদের সঙ্গেও দেখা করেন। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রবল বর্ষণে ভেসে যাওয়া বা ধসে চাপা পড়া গ্রামগুলোতে রাস্তা ভেঙে যাওয়ার কারণে অনেক জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও উদ্ধারকারীরা বিকল্প রাস্তা তৈরি করে এবং হেলিকপ্টারের সাহায্যে খাদ্য, ঔষধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছেন।
হিমাচল প্রদেশে পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদী পাঞ্জাবেও যাবেন। সেখানেও প্রবল বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পাঞ্জাবে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং ত্রাণ-উদ্ধার কার্যক্রম ঘুরে দেখবেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুমেও হিমাচল প্রদেশে অভূতপূর্ব বন্যা ও ভূমিধস দেখা গিয়েছিল। বহু সেতু ভেঙে পড়েছিল, শতাধিক গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এবছর তুলনামূলক কম প্রাণহানি হলেও, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি বহু গুণ বেশি হয়েছে বলে মনে করছে প্রশাসন। পাহাড়ি এলাকায় যত্রতত্র হঠাৎ মেঘফাটা এবং ভূমিধস এই অঞ্চলের ভৌগোলিক দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং ঘন ঘন মেঘফাটা ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য চিন্তার বিষয়।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বহু মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। কৃষকদের মাঠের ধান, ভুট্টা, আপেলসহ একাধিক ফসল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। পর্যটননির্ভর অর্থনীতিও বড় ধাক্কা খেয়েছে। কুল্লু ও মান্ডি অঞ্চলে যেখানে শীতকালীন মরসুমে বিপুল পর্যটক ভিড় জমে, সেখানে সড়ক ধসে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। হোটেল ব্যবসায়ীরাও আশঙ্কা করছেন, আসন্ন শীতকালীন মরসুমে পর্যটন শিল্প ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফরকে ঘিরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, কেন্দ্র থেকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা ঘোষণা হবে, যাতে ভেঙে পড়া অবকাঠামো মেরামত করা যায় এবং জীবিকা পুনর্গঠনের কাজে সহায়তা পাওয়া যায়। কেন্দ্র ইতিমধ্যেই আশ্বাস দিয়েছে, সব রকম সহযোগিতা করা হবে এবং রাজ্যের পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করা হবে।
সবমিলিয়ে, হিমাচল প্রদেশ আজ এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করছে। এই বিপর্যয় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নয়, গোটা রাজ্যের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি পরিদর্শন ও কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতি আগামী দিনে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় নতুন আশার আলো জাগাচ্ছে।