সিমলা চুক্তির ঐতিহাসিক টেবিল থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরানো হল

ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজভবনে অবস্থিত ঐতিহাসিক কাঠের টেবিল, যেখানে ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি (Simla Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখান থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই…

Pakistani Flag Removed from Simla Agreement Desk After Accord Suspension

ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজভবনে অবস্থিত ঐতিহাসিক কাঠের টেবিল, যেখানে ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি (Simla Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখান থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি স্থগিত করার একদিন পর নেওয়া হয়েছে, যা জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের কঠোর পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

   

সিমলা চুক্তির টেবিল ও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব

সিমলার রাজভবনের কীর্তি হলে অবস্থিত এই চকচকে কাঠের টেবিলটি একটি লাল রঙের উঁচু প্ল্যাটফর্মে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর একটি ফলকে লেখা রয়েছে, “সিমলা চুক্তি এখানে ৩-৭-১৯৭২ তারিখে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।” এই এলাকাটি পিতলের রেলিং দিয়ে ঘেরা। টেবিলের পিছনে দুটি চেয়ার রাখা আছে, এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর চুক্তি স্বাক্ষরের একটি ছবি টেবিলের একপাশে প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ সম্মেলনের আরও অনেক ছবি টেবিলের পিছনের দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে। এতদিন টেবিলের উপর ভারত ও পাকিস্তানের পতাকা একসঙ্গে রাখা ছিল, কিন্তু এখন শুধু ভারতের পতাকাই দৃশ্যমান।

সিমলা চুক্তি কী?

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ৯০,০০০-এর বেশি পাকিস্তানি সেনা পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে দুই সপ্তাহের তীব্র যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনা পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধবিরতি এবং ভারতের বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়, যার ফলে বাংলাদেশের জন্ম হয়। সিমলা চুক্তি ছিল ইন্দিরা গান্ধী এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই স্বাক্ষরিত একটি শান্তি চুক্তি। এর লক্ষ্য ছিল “দুই দেশের মধ্যে সংঘাত ও মুখোমুখি অবস্থানের অবসান ঘটানো এবং উপমহাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা।” এই চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দুই দেশের সেনাবাহিনীর অবস্থানের সীমানা নির্ধারণ করে। অতীতে পাকিস্তান এই চুক্তি বারবার লঙ্ঘন করেছে।

পাকিস্তানের চুক্তি স্থগিতকরণ

পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পর পাকিস্তান ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর সিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে। ইসলামাবাদ ইন্দাস জল চুক্তির অধীনে পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জল প্রবাহে কোনও পরিবর্তনকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে গণ্য করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। পাকিস্তান বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বিমানসীমা এবং ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা ছাড় স্কিমের (এসভিইএস) অধীনে সমস্ত ভিসা স্থগিত করেছে, যদিও শিখ ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

পহেলগাঁও হামলা এবং ভারতের পদক্ষেপ

মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায়, যা ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত, একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে, যার মধ্যে একজন নেপালি নাগরিকও ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গুলির শব্দে পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু খোলা মাঠে তাদের লুকানোর কোনও জায়গা ছিল না। সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনী (সিআরপিএফ) এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এলাকাটি ঘিরে ফেলে সন্ত্রাসীদের খোঁজে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে।

ভারত কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে ইন্দাস জল চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে। এর ফলে ইন্দাস নদী এবং এর উপনদী যমুনা ও চেনাবের জল প্রবাহ বন্ধ বা পুনর্নির্দেশিত হতে পারে। এছাড়া, আটারি-ওয়াঘা সীমান্তের সমন্বিত চেকপোস্ট বন্ধ করা হয়েছে, এবং বৈধ অনুমোদন নিয়ে ভারতে আসা পাকিস্তানি নাগরিকদের ১ মে-র আগে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। সার্ক ভিসা ছাড় স্কিমের অধীনে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পহেলগাঁও হামলার পিছনে থাকা প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং তাদের সমর্থকদের “চিহ্নিত, অনুসরণ এবং শাস্তি” দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

জনমত এবং প্রতীকী তাৎপর্য

সিমলা চুক্তির টেবিল থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরিয়ে ফেলা একটি শক্তিশালী প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি পাকিস্তানের চুক্তি স্থগিতকরণের প্রতি ভারতের কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন। সামাজিক মাধ্যমে এই পদক্ষেপের প্রশংসা করা হচ্ছে। এক্স-এ একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “সিমলা চুক্তির টেবিল থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরানো ভারতের দৃঢ় বার্তা। পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের জন্য মূল্য দিতে হবে।”

সিমলা চুক্তির টেবিল থেকে পাকিস্তানের পতাকা সরানো এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের ইন্দাস জল চুক্তি স্থগিতকরণ এবং পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এবং উভয় দেশের সংযমী পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।