ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তে চলমান শত্রুতা বন্ধ করার জন্য একটি সমঝোতার ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তান পুনরায় এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে (Pakistan ceasefire violation)। জম্মু ও কাশ্মীরের সাম্বা, আখনুর এবং উধমপুর অঞ্চলে ভারী গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে, যা গত চার দিনের তীব্র সামরিক সংঘাতের পর উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে করা সমঝোতার গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, উধমপুরে একটি ড্রোন হামলাও সংঘটিত হয়েছে, যা ইতিমধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এছাড়া, শ্রীনগরে ৭-৮টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যা অঞ্চলটিতে সহিংসতা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নে, পাঞ্জাবের পাঠানকোটেও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণ আগে এই এলাকায় পাকিস্তানি ড্রোন দেখা গেছে বলে জানা গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাঠানকোট এবং গুরুদাসপুরে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট জারি করেছে, যাতে সম্ভাব্য বায়বীয় হুমকি রোধ করা যায়। এখনও পর্যন্ত এই এলাকায় কোনো বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়নি, তবে উভয় জেলায় এয়ার রেইড সাইরেন সক্রিয় করা হয়েছে।
জরুরি পদক্ষেপ ও সতর্কতা
কুচের সীমান্তে হারামি নালা এবং খাভদার কাছে পাকিস্তানি ড্রোন দেখা যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলে ব্ল্যাকআউট পালনের স্পষ্ট নির্দেশ জারি করেছে। বারমেরে এয়ার রেইড সাইরেন সক্রিয় করা হয়েছে, যা উচ্চতর নিরাপত্তা ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। এদিকে, উধমপুরে ড্রোন হামলা অব্যাহত রয়েছে, এবং সামরিক বাহিনী পরিস্থিতির উপর নিবিড় নজর রাখছে।
দিনের শুরুতে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন, যা স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রপথে সমস্ত সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল। এই সমঝোতা সন্ধ্যা ৫টা (আইএসটি) থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এটি সামরিক ব্যস্ততা হ্রাস এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। মিসরি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে এই চুক্তি অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথ প্রশস্ত করবে। তবে, পাকিস্তানের নতুন করে সামরিক পদক্ষেপ শান্তির প্রতি তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে, বিশেষ করে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরিপ্রেক্ষিতে।
অপারেশন সিঁদুর ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
‘অপারেশন সিঁদুর’ ছিল পাকিস্তান-প্রশাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু অংশে সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি উচ্চ-প্রোফাইল অভিযান। এই অভিযানে জৈশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়বার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ১০০ জনেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই অভিযানটি পাকিস্তান থেকে উৎপন্ন একাধিক সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চালানো হয়েছিল, বিশেষ করে ২২ এপ্রিল পাহালগামে ২৬ জন পর্যটকের নিহত হওয়ার ঘটনার পর। অভিযানটি আরও উত্তেজনার আশঙ্কা তৈরি করেছিল, যা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই অভিযানকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে অভিহিত করে ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ শুরু করেছে, যার অধীনে তারা ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারত তাদের নূর খান, রফিকি এবং মুরিদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, যদিও তারা এই দাবির পক্ষে কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেনি।
বর্তমান পরিস্থিতি
সাম্বা, আখনুর এবং উধমপুরে পাকিস্তানের গুলিবর্ষণের ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শ্রীনগরে বিস্ফোরণের শব্দ এবং উধমপুরে ড্রোন হামলা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। পাঠানকোট এবং গুরুদাসপুরে ব্ল্যাকআউট এবং এয়ার রেইড সাইরেন স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কুচের সীমান্তে হারামি নালা এবং খাভদায় ড্রোনের উপস্থিতি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এই হামলাগুলোর জবাবে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিরক্ষা সূত্র জানিয়েছে, জম্মু অঞ্চলের কাছে পাকিস্তানি পোস্ট এবং সন্ত্রাসী লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করা হয়েছে, যেখান থেকে টিউব-লঞ্চড ড্রোন চালানো হচ্ছিল। ভারতের এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ইন্টিগ্রেটেড কাউন্টার ইউএএস গ্রিড পাকিস্তানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিরপেক্ষ করতে সফল হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শন এবং দ্রুত ডি-এস্কেলেশনের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাত বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক।” যুক্তরাজ্য, চীন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও উভয় দেশকে সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে, ভারত শিমলা চুক্তি এবং লাহোর ঘোষণার উপর জোর দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
এই সংঘাতের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং গুজরাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এবং ভারতের ৩২টি বিমানবন্দরে বেসামরিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে। সীমান্ত এলাকায় ব্ল্যাকআউট এবং সাইরেনের শব্দে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা এই সংঘাতকে বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক করে তুলেছে। ভারতের কাছে প্রায় ১৭২টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। যেকোনো ভুল গণনা বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হতে পারে।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিলতা এবং কাশ্মীর ইস্যুতে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনাকে তুলে ধরেছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করলেও, পাকিস্তানের পাল্টা হামলা এবং যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন শান্তি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং উভয় দেশের সংযম এই সংকট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে সংলাপের পথে ফিরতে হবে।