ভারতের মিসাইল হামলা কেন আটকাতে পারল না পাকিস্তান? জানুন চাঞ্চল্যকর তথ্য

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এই দুই পরমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাতের মাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ভারত মঙ্গল ও বুধবার মধ্যরাতে…

peshawar attacked by indian army

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এই দুই পরমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাতের মাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ভারত মঙ্গল ও বুধবার মধ্যরাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে নয়টি জঙ্গি ঘাঁটিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর (Operation Sindoor) অধীনে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। এই হামলায় ভারত সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করেছে, যা শব্দের চেয়ে তিনগুণ দ্রুত গতিতে উড়ে আসে। পাকিস্তানের প্রাথমিক তদন্তে এই তথ্য প্রকাশ পেলেও, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে তা নিশ্চিত করেনি। এই হামলা পাকিস্তানের বিমান-হামলা প্রতিরোধ ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কেন আটকাতে পারল না, তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব এবং উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করব।

হামলার পটভূমি

২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর মারাত্মক জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বা (LeT) এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদ (JeM)-কে দায়ী করেছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অধীনে ভারতীয় বিমানবাহিনী বাহাওয়ালপুর ও মুরিদকে সহ নয়টি লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় ভারত রাফায়েল যুদ্ধবিমান থেকে স্কাল্প ক্রুজ মিসাইল এবং হ্যামার নির্ভুল-নির্দেশিত বোমা ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। তবে পাকিস্তানের তদন্তে উঠে এসেছে যে, সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল, সম্ভবত ব্রহ্মোস এই হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে।

   

ব্রহ্মোস মিসাইল ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি, যা ম্যাক ৩.৫ গতিতে (অর্থাৎ শব্দের তিনগুণেরও বেশি গতি) উড়তে পারে এবং ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম। এই মিসাইলের নিম্ন-উচ্চতায় উড়ার ক্ষমতা এবং উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম এটিকে রাডারে ধরা কঠিন করে তোলে। পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতীয় শহর সিরসা থেকে এই মিসাইলগুলো ছোঁড়া হয়েছিল এবং তিন মিনিট ৪৪ সেকেন্ড ধরে পাকিস্তানের আকাশে উড়েছিল।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা

পাকিস্তানের সামরিক সূত্র দাবি করেছে, তারা মিসাইলগুলোর উপর নজরদারি রেখেছিল। তবে প্রশ্ন উঠেছে, যদি তারা মিসাইলগুলো ট্র্যাক করতে পারত, তাহলে কেন তা আটকানো গেল না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানের বিমান-হামলা প্রতিরোধ ব্যবস্থার সক্ষমতা এবং সুপারসনিক মিসাইলের প্রযুক্তিগত জটিলতা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

পাকিস্তানের বিমান-হামলা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় চীনের তৈরি এইচকিউ-৯ এবং এইচকিউ-১৬ এফই সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম রয়েছে। এইচকিউ-৯ সিস্টেমটি ২০২১ সালে পাকিস্তানে সংযোজিত হয়, যা ক্রুজ মিসাইল এবং বিমানের বিরুদ্ধে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কার্যকর। তবে, এই সিস্টেমটি মূলত ভূমি থেকে ভূমিতে ছোঁড়া মিসাইল এবং কম গতির ক্রুজ মিসাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর। আকাশ থেকে ভূমিতে ছোঁড়া সুপারসনিক মিসাইল, বিশেষ করে ব্রহ্মোসের মতো অতি-দ্রুতগতির মিসাইল, আটকানোর জন্য এই সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রাক্তন ভাইস এয়ার মার্শাল ইক্রামাতুল্লা ভাট্টি বিবিসিকে বলেছেন, “আকাশ থেকে ভূমিতে ছোঁড়া মিসাইলগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতির, ম্যাক ৩ (৩৬৭৫ কিমি/ঘণ্টা) থেকে ম্যাক ৯ (১১০২৫ কিমি/ঘণ্টা) পর্যন্ত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনের মতো দেশগুলোরও এই গতির মিসাইল আটকানোর পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তি নেই।” তিনি আরও বলেন, এই মিসাইলগুলো নিম্ন-উচ্চতায় উড়ে এবং অল্প সময়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, যা প্রতিক্রিয়ার জন্য সময় কমিয়ে দেয়। ভূমি থেকে ভূমিতে ছোঁড়া মিসাইলের তুলনায় আকাশ থেকে ছোঁড়া মিসাইল আটকানো অনেক বেশি কঠিন।

প্রাক্তন এয়ার কমোডর আদিল সুলতানের মতে, কোনো দেশেরই হামলা আটকানোর ‘ফুল-প্রুফ’ ব্যবস্থা নেই, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে, যাদের সীমান্ত একই। তিনি বলেন, “একই সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের মিসাইল ছোঁড়া হলে যেকোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়।” তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান ২০১৯ সালের বালাকোট হামলার পর উন্নত রাডার এবং মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করেছে, কিন্তু ২৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে পুরোপুরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব।

ভারতের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব

ভারতের সামরিক সক্ষমতা, বিশেষ করে মিসাইল প্রযুক্তিতে, পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। ব্রহ্মোস মিসাইল, যা ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি, বিশ্বের দ্রুততম ক্রুজ মিসাইলগুলোর একটি। এটি ৫ মিটার নিম্ন-উচ্চতায় উড়তে পারে, যা রাডারে ধরা কঠিন করে। এর সর্বোচ্চ পরিসর ৮০০ কিলোমিটার, এবং এটি ২০০-৩০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে পারে। ব্রহ্মোসের এয়ার-লঞ্চড ভার্সন সু-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া যায়, যা এটিকে আরও মারাত্মক করে।

ভারত ২০১৯ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান-বিধ্বংসী মিসাইল সিস্টেম কিনেছে, যা ৪০০ কিলোমিটার পরিসরে হুমকি নির্মূল করতে পারে। এই সিস্টেমটি পাকিস্তানের ড্রোন এবং মিসাইল হামলা প্রতিহত করতে সফল হয়েছে, যেমনটি ৭-৮ মে রাতে দেখা গেছে। তবে, আদিল সুলতানের মতে, ভারতেরও আকাশ থেকে ভূমিতে ছোঁড়া সুপারসনিক মিসাইল আটকানোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নেই। এটি উভয় দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।

Advertisements

উভয় দেশের বিমানবাহিনীর তুলনা

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তানের তুলনায় সংখ্যা এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে। ভারতের কাছে ৩১টি স্কোয়াড্রন রয়েছে, প্রতিটিতে ১৭-১৮টি যুদ্ধবিমান, মোট ২,২২৯টি বিমান, যার মধ্যে ৬৪৩টি যুদ্ধবিমান। পাকিস্তানের ১১টি স্কোয়াড্রনে মোট ১,৩৯৯টি বিমান রয়েছে, যার মধ্যে ৪১৮টি যুদ্ধবিমান। ভারতের রাফাল এবং মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের এফ-১৬ এবং জেএফ-১৭ থান্ডারের তুলনায় উন্নত। রাফাল পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে এবং ৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।

ভারতের কাছে ৯৭৯টি হেলিকপ্টার রয়েছে, যার মধ্যে ৮০টি আক্রমণাত্মক, যেখানে পাকিস্তানের ৪৩০টি হেলিকপ্টারের মধ্যে ৫৭টি আক্রমণাত্মক। ভারতের ৩১১টি সামরিক বিমানঘাঁটির তুলনায় পাকিস্তানের রয়েছে ১১৬টি। এই সংখ্যাগত এবং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব ভারতকে সামরিক অভিযানে সুবিধা দেয়।

কেন আটকানো গেল না?

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ভারতের কৌশলগত সুবিধাও এই হামলার সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, ব্রহ্মোস মিসাইলের সুপারসনিক গতি এবং নিম্ন-উচ্চতায় উড়ার ক্ষমতা এটিকে রাডারে ধরা কঠিন করে। দ্বিতীয়ত, ভারত রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে, যা উন্নত স্টিলথ প্রযুক্তি এবং দীর্ঘ-পরিসরের আঘাত ক্ষমতা সম্পন্ন। তৃতীয়ত, ভারতের গোয়েন্দা তথ্য এবং রিয়েল-টাইম নজরদারি এই হামলাকে নির্ভুল করেছে।

পাকিস্তানের এইচকিউ-৯ সিস্টেমটি সুপারসনিক মিসাইলের বিরুদ্ধে সীমিত কার্যকারিতা রাখে, বিশেষ করে যখন মিসাইলগুলো আকাশ থেকে ছোঁড়া হয়। উপরন্তু, ভারতের হামলা একাধিক দিক থেকে এবং বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে সমন্বিতভাবে চালানো হয়েছিল, যা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করেছে। পাকিস্তানের ২৫০০ কিলোমিটার সীমান্তে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব, এবং এই দুর্বলতা ভারত কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ

এই হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “দুই পরমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাত বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক।” ভারত দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হামলার চেষ্টা, যেমন জম্মুতে হামাস-শৈলীর মিসাইল হামলা এবং ড্রোন অনুপ্রবেশ, ভারতের এস-৪০০ সিস্টেম দ্বারা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তবে, পাকিস্তানের কাছে শাহিন-৩ (২,৭৫০ কিমি) এবং বাবুর ক্রুজ মিসাইলের মতো অস্ত্র রয়েছে, যা ভারতের শহরগুলোকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এই পারস্পরিক হুমকি দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।

পাকিস্তান ভারতের সুপারসনিক মিসাইল হামলা আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে মূলত তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং ভারতের উন্নত অস্ত্র ও কৌশলগত সুবিধার কারণে। ব্রহ্মোসের মতো মিসাইলের দ্রুত গতি, নিম্ন-উচ্চতায় উড়ার ক্ষমতা এবং রাফালের মতো যুদ্ধবিমানের স্টিলথ প্রযুক্তি পাকিস্তানের এইচকিউ-৯ সিস্টেমকে অকার্যকর করেছে। তবে, ভারতেরও আকাশ থেকে ছোঁড়া সুপারসনিক মিসাইল আটকানোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নেই, যা উভয় দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরে।

দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। উভয় দেশের পরমাণবিক সক্ষমতা এবং উন্নত মিসাইল প্রযুক্তি বিবেচনা করে, একটি ছোট ভুল বা ভুল বোঝাবুঝি বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ এবং নেতৃত্বকে সংযম এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকে।