ভারতের অপারেশনে বাহাওয়ালপুরে জইশ সদর দপ্তর ‘চিরতরে বন্ধ’

পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-এ-মহম্মদ (জেইএম)-এর সদর দপ্তর, যা ‘জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ’ নামে পরিচিত, ভারতের একটি লক্ষ্যবস্তু বিমান হামলার পর গুগল ম্যাপে “স্থায়ীভাবে বন্ধ” হিসেবে…

Operation Sindoor, Jaish-e-Mohammed, headquarters closed

পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-এ-মহম্মদ (জেইএম)-এর সদর দপ্তর, যা ‘জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ’ নামে পরিচিত, ভারতের একটি লক্ষ্যবস্তু বিমান হামলার পর গুগল ম্যাপে “স্থায়ীভাবে বন্ধ” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই স্থাপনা, যা ভারতীয় সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে, ৭ মে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর (Operation Sindoor) অংশ হিসেবে আঘাতপ্রাপ্ত নয়টি জঙ্গি শিবিরের মধ্যে একটি। এই অভিযান ছিল ২২ এপ্রিল পাহালগামে সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়া, যাতে ২৬ জন নিহত হয়েছিল। উপগ্রহ চিত্র এবং হামলা-পরবর্তী দৃশ্যপট নিশ্চিত করে যে এই স্থাপনাটি ব্যাপক কাঠামোগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে ভবনের বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ছাদে বিশাল গর্ত সৃষ্ট হয়েছে।

জইশ-এ-মহম্মদের সদর দপ্তর: একটি জঙ্গি কেন্দ্র
জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ নামে পরিচিত এই স্থাপনাটি সর্বজনীনভাবে একটি মসজিদ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি জইশ-এ-মহম্মদের প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। এই কমপ্লেক্স, যা ১৮ একর জমির উপর বিস্তৃত এবং উসমান-ও-আলী ক্যাম্পাস নামেও পরিচিত, নিয়োগ, তহবিল সংগ্রহ এবং জঙ্গি কার্যকলাপের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সূত্র অনুযায়ী, এই কেন্দ্রটি ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা সহ ভারতে বেশ কয়েকটি বড় জঙ্গি হামলার পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হয়েছিল। জইশ-এ-মহম্মদ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন জাতিসংঘ-ঘোষিত বৈশ্বিক জঙ্গি মাওলানা মাসুদ আজহার, ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদ হামলা, ২০১৬ সালের পাঠানকোট বিমানঘাঁটি হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্য দায়ী, যাতে ৪০ জন সিআরপিএফ কর্মী নিহত হয়েছিল।

   

অপারেশন সিঁদুর: ভারতের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালের ৭ মে ভোর ১:০৫ থেকে ১:৩০ মিনিটের মধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি নির্ভুল হামলা চালায়, যা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি জঙ্গি শিবিরকে লক্ষ্য করে। এই অভিযানে জইশ-এ-মহম্মদ এবং লস্কর-এ-তৈয়বার (এলইটি) সদর দপ্তর সহ হিজবুল মুজাহিদিনের স্থাপনাগুলিও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বাহাওয়ালপুরের জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ ছিল এই হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ভারতীয় সামরিক বাহিনী জানিয়েছে যে কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করা হয়নি, এবং হামলাগুলি ছিল “কেন্দ্রীভূত, পরিমিত এবং অ-উত্তেজক”।

হামলার পর উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে যে বাহাওয়ালপুরের মারকাজ সুবহান আল্লাহ কমপ্লেক্স ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের ছাদে বিশাল গর্ত এবং চারপাশে ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে একচেটিয়াভাবে প্রকাশ করেছে। জইশ নেতা মাসুদ আজহার নিজে স্বীকার করেছেন যে এই হামলায় তার পরিবারের ১০ জন সদস্য এবং চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে তার বড় বোন, তার স্বামী, একজন ভাইপো এবং তার স্ত্রী, একজন ভাইঝি এবং পাঁচটি শিশু রয়েছে।

গুগল ম্যাপে ‘স্থায়ীভাবে বন্ধ’ চিহ্ন
হামলার পর, গুগল ম্যাপে জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহকে “স্থায়ীভাবে বন্ধ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই চিহ্ন সাধারণত কোনো স্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী নিষ্ক্রিয়তা বা ক্ষতির রিপোর্ট নিশ্চিত হওয়ার পর প্রয়োগ করা হয়। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলার আগে এই কমপ্লেক্স থেকে ছাত্রদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তবে মাসুদ আজহার এবং তার পরিবার সেখানে অবস্থান করছিল। এই চিহ্নিতকরণ জইশ-এ-মহম্মদের কার্যক্রমে ভারতের এই হামলার তাৎপর্যকে আরও জোরালো করে।

অপারেশন সিঁদুরের অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু
বাহাওয়ালপুর ছাড়াও, ভারত পাকিস্তান এবং পিওকে-তে আরও আটটি জঙ্গি শিবিরে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
• মুরিদকে মারকাজ তাইবা (লস্কর-এ-তৈয়বার সদর দপ্তর)
• সিয়ালকোটের সারজাল শিবির (হিজবুল মুজাহিদিন)
• সিয়ালকোটের মেহমুনা জোয়া শিবির (হিজবুল মুজাহিদিন)
• কোটলির আব্বাস শিবির (লস্কর-এ-তৈয়বা)
• কোটলির গুলপুর শিবির (লস্কর-এ-তৈয়বা)
• মুজাফফরাবাদের সৈয়দনা বিলাল শিবির (জইশ-এ-মহম্মদ)
• মুজাফফরাবাদের সাওয়াই নালা শিবির (লস্কর-এ-তৈয়বা)

Advertisements

এই হামলাগুলি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)-এর নিবিড় নজরদারির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছিল, যা এই লক্ষ্যবস্তুগুলির সনাক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রভাব
অপারেশন সিঁদুর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান দাবি করেছে যে এই হামলায় বেসামরিক এলাকা এবং মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, ভারত জোর দিয়ে বলেছে যে হামলাগুলি শুধুমাত্র জঙ্গি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করেছে। পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় জম্মু ও কাশ্মীরের লাইন অফ কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর গোলাবর্ষণে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও, পাকিস্তান ড্রোন অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

অপারেশন সিঁদুর জইশ-এ-মহম্মদ এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের অবকাঠামোর উপর একটি গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাহাওয়ালপুরের জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ ধ্বংস এবং গুগল ম্যাপে এটির “স্থায়ীভাবে বন্ধ” চিহ্নিতকরণ ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের প্রতীক। এই হামলা কেবল জইশ-এ-মহম্মদের কার্যক্রমকে দুর্বল করেনি, বরং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে। তবে, এই অভিযানের ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।