ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী তেল (oil-gas prices) সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারত, যেটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ, এই সম্ভাব্য ‘ক্রুড তেলের ধাক্কা’-র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রণালয় সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং বিকল্প তেল সরবরাহের পথ খুঁজছে।
ইরানের হোর্মুজ (oil-gas prices) প্রণালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকির মধ্যে ভারতের প্রায় ৪০% ক্রুড তেল এবং ৫৪% এলএনজি আমদানি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই সংকট ভারতের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি এবং জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
হোর্মুজ প্রণালীর গুরুত্ব
হোর্মুজ প্রণালী বিশ্বের তেল বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, যার মাধ্যমে প্রায় ২০% ক্রুড তেল (oil-gas prices) এবং ২৫% প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহন হয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত তীব্র হওয়ায় ইরান এই প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এই প্রণালী যুদ্ধের সময়েও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি, বর্তমানে ইরানের সামরিক তৎপরতা এবং ইসরায়েলের তেল স্থাপনায় হামলা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হোর্মুজ বন্ধ হলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা ভারতের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হবে।
ভারতের তেল আমদানি ও ঝুঁকি (oil-gas prices)
ভারত তার তেল (oil-gas prices) চাহিদার প্রায় ৯০% আমদানির উপর নির্ভর করে, যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো (ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার) থেকে প্রায় ৪০% আসে। এই আমদানি হোর্মুজ প্রণালীর মাধ্যমে পরিবহন হয়। ২০২৪ সালে ভারতের ক্রুড তেল আমদানি বিল ছিল জিডিপির প্রায় ৪%। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে ভারত রাশিয়া থেকে ২-২.২ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন (বিপিডি) ক্রুড তেল আমদানি করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মোট আমদানির চেয়ে বেশি। তবে, হোর্মুজে বিঘ্ন ঘটলে এই বিকল্প পথও পর্যাপ্ত হবে না।
ভারতের প্রস্তুতি
ভারত সরকার বিকল্প তেল সরবরাহের পথ অনুসন্ধান করছে। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর সঙ্গে তেল (oil-gas prices) আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল আমদানি ২৮০,০০০ বিপিডি থেকে বেড়ে ৪৩৯,০০০ বিপিডি হয়েছে। এছাড়া, ভারত তার কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (এসপিআর) ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, যা বর্তমানে ৯-১০ দিনের আমদানি চাহিদা মেটাতে পারে। মঙ্গলোর, বিশাখাপত্তনম এবং পাদুরে এই রিজার্ভ অবস্থিত।
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় বিকল্প পরিবহন পথের উপরও জোর দিচ্ছে। আবু ধাবি-ফুজাইরাহ পাইপলাইন, সৌদি আরবের পূর্ব-পশ্চিম পাইপলাইন এবং ইরাক-তুরস্ক পাইপলাইন হোর্মুজ প্রণালী বাইপাস করতে পারে। এছাড়া, ভারতের পূর্ব উপকূলে এলএনজি টার্মিনাল সম্প্রসারণের মাধ্যমে অ-গাল্ফ এলএনজি আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
তেলের দাম বৃদ্ধি (oil-gas prices) ভারতের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে। প্রতি ১০ ডলার দাম বৃদ্ধিতে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ০.৫৫% বাড়ে এবং গ্রাহক মূল্য সূচক (সিপিআই) ০.৩% বৃদ্ধি পায়। এটি পেট্রোল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের দাম বাড়াবে, যা সাধারণ মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে শিল্পখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) জানিয়েছে, ভারত ২০২৭ সালের মধ্যে চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম তেল চাহিদা বৃদ্ধির উৎস হবে। ২০২৪ সালে ভারতের তেল চাহিদা ছিল ৫.৬৪ মিলিয়ন বিপিডি, যা ২০৩০ সালে ৬.৬৬ মিলিয়ন বিপিডি হবে। এই চাহিদা মেটাতে আমদানি আরও বাড়বে, যা ভারতকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
ইরানের তেল (oil-gas prices) রপ্তানি, যা বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৩%, প্রধানত চীনের দিকে যায়। তবে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ইসরায়েলের হামলা ইরানের রপ্তানি কমাতে পারে, যা তেলের দাম আরও বাড়াবে। এছাড়া, হুথি বিদ্রোহীদের লোহিত সাগরে জাহাজে হামলার হুমকি শিপিং খরচ বাড়াচ্ছে।
আইইএ-র মতে, বিশ্বব্যাপী তেল উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালে ১১৪.৭ মিলিয়ন বিপিডি হবে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। তবে, স্বল্পমেয়াদে ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি তেলের দাম বাড়াতে পারে। সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০ সাল পর্যন্ত উৎপাদন বৃদ্ধির ৪০% অবদান রাখবে।
কাঁথি কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির নির্বাচনে বিজেপির জয়জয়কার
ভারতের কৌশল
ভারত দীর্ঘমেয়াদে শক্তি নিরাপত্তা বাড়াতে নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের উপর জোর দিচ্ছে। আইইএ-র মতে, বৈদ্যুতিক যান এবং শক্তি দক্ষতা উন্নতির ফলে ২০২৩-২০৩০ সালে ৪৮০,০০০ বিপিডি তেল চাহিদা এড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়া, জৈব জ্বালানি পরিবহন খাতের কার্বন নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা রাখবে।
সরকার দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬.৫ মিলিয়ন টন ক্রুড তেল ধারণক্ষমতার কৌশলগত রিজার্ভ তৈরির পরিকল্পনা করছে। এটি ভারতের আমদানি চাহিদার আরও কয়েক দিন কভার করতে সাহায্য করবে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহে বিঘ্নের আশঙ্কা ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি বৃদ্ধি, কৌশলগত রিজার্ভ ব্যবহার এবং বিকল্প পথের উপর নির্ভর করে ভারত এই সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। দীর্ঘমেয়াদে, শক্তি বৈচিত্র্যকরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উপর জোর দেওয়া ভারতকে এই ধরনের তেল শক থেকে রক্ষা করতে পারে। এই সংকট ভারতের শক্তি নিরাপত্তা নীতির গুরুত্ব আরও তুলে ধরেছে।