ওড়িশার বিধায়ক তথা প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) মন্ত্রী প্রায় দেড় মাসের মধ্যে ১.৪ কোটি টাকা সাইবার জালিয়াতির (Cyber Fraud) কবলে হারিয়েছেন। সোমবার (৩১ মার্চ) এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। এই ঘটনায় পুলিশ কর্ণাটক থেকে চারজন এবং তামিলনাড়ু থেকে তিনজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে, প্রাক্তন মন্ত্রী দাবি করেছেন যে তিনি সরাসরি এই জালিয়াতির শিকার হননি, বরং তার এক বন্ধু তার ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এই টাকা হারিয়েছেন।
ঘটনার বিবরণ
ওড়িশা ক্রাইম ব্রাঞ্চের আইজি সার্থক সারঙ্গি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “গত ১৩ জানুয়ারি আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছিলাম যে সাইবার জালিয়াতরা একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগকারীর কাছ থেকে ১.৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।” তিনি অভিযোগকারীর নাম প্রকাশ করেননি, কারণ এটি তদন্তে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগকারী একজন বর্তমান বিধায়ক, প্রাক্তন আইটি মন্ত্রী এবং আইআইটি থেকে স্নাতক। বিজেডি বিধায়ক এবং প্রাক্তন আইটি মন্ত্রী তুষারকান্তি বেহেরা সাংবাদিকদের বলেন, “আমার এক বন্ধু আমার ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছিল এবং সে সাইবার জালিয়াতির কারণে টাকা হারিয়েছে। আমার এই জালিয়াতি সম্পর্কে সরাসরি কোনো জ্ঞান নেই।”
তদন্তে জানা গেছে, অভিযুক্তরা নিজেদের ট্রেড অ্যানালিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে লোকজনকে ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও), শেয়ার এবং অন্যান্য ট্রেডিংয়ে বিনিয়োগের জন্য প্রলোভন দেখাত। তারা উচ্চ মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুক্তভোগীদের ফাঁদে ফেলত। ক্রাইম ব্রাঞ্চের সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে অভিযুক্তরা ১.৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তদন্ত ও গ্রেপ্তার
সারঙ্গি জানান, জালিয়াতির টাকা কর্ণাটক, কেরল, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, হিমাচল প্রদেশ, আসাম এবং মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ক্রাইম ব্রাঞ্চের দল কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং কেরলে গিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কর্ণাটক থেকে চারজন এবং তামিলনাড়ু থেকে তিনজন রয়েছেন। “খুব শীঘ্রই আমরা হায়দ্রাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লিতে দল পাঠাব অন্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে,” সারঙ্গি যোগ করেন।
এখন পর্যন্ত ক্রাইম ব্রাঞ্চ অভিযুক্তদের কাছ থেকে ৪ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছে এবং তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। তবে, এই পরিমাণ মোট ক্ষতির তুলনায় খুবই কম। সারঙ্গি আরও জানান, সাম্প্রতিক সময়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং একজন নৌবাহিনীর কর্মকর্তাও সাইবার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন, যা এই ধরনের অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রকোপের ইঙ্গিত দেয়।
জালিয়াতির কৌশল
পুলিশের তদন্তে প্রকাশ, অভিযুক্তরা একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে এই জালিয়াতি চালিয়েছে। তারা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ করে এবং আইপিও এবং ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) ট্রেডিংয়ে বিনিয়োগের জন্য প্রলুব্ধ করত। উচ্চ রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ভুক্তভোগীদের আস্থা অর্জন করত এবং পরে টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেত। এই ক্ষেত্রে, অভিযোগকারী ১.৪ কোটি টাকা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন, যা পরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
সাইবার অপরাধের উত্থান
ওড়িশায় সাইবার অপরাধ গত কয়েক বছরে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালে রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সাইবার জালিয়াতরা ১২২.৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ২.৮৭ কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ঘটনায় প্রাক্তন আইটি মন্ত্রীর মতো একজন শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির শিকার হওয়া সাইবার অপরাধীদের কৌশলের পরিশীলিততা এবং সাধারণ মানুষের জন্য এর ঝুঁকি তুলে ধরে। তুষারকান্তি বেহেরা আইআইটি খড়গপুর থেকে বায়োটেকনোলজিতে এমটেক ডিগ্রিধারী। এমন একজন ব্যক্তির এই জালিয়াতির শিকার হওয়া প্রমাণ করে যে সাইবার অপরাধীরা কতটা ধূর্তভাবে তাদের ফাঁদ পাতে।
পুলিশের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ক্রাইম ব্রাঞ্চ এই মামলায় তদন্ত ত্বরান্বিত করেছে। গ্রেপ্তারকৃত সাতজনকে ট্রানজিট রিমান্ডে ওড়িশায় আনা হচ্ছে। পুলিশ এখন দ্বিতীয় স্তরের অ্যাকাউন্টগুলোর দিকে নজর দিয়েছে, যেখানে টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। সারঙ্গি জানান, “আমরা এই জালিয়াতির মূল মাথাকে ধরতে চাই। তদন্তে আরও অনেক কিছু প্রকাশ পাবে।” পুলিশ এই ধরনের অপরাধ রুখতে সাইবার ক্রাইম সেলকে আরও শক্তিশালী করছে এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে।
এই ঘটনা ওড়িশায় সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। একজন প্রাক্তন আইটি মন্ত্রী যিনি রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি নিজেই যদি এই ধরনের জালিয়াতির শিকার হন, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং প্রতারণার কৌশল দিন দিন উন্নত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণকে সতর্ক করা এবং তাদের ডিজিটাল লেনদেনে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
এই সাইবার জালিয়াতি কেবল একটি আর্থিক ক্ষতির ঘটনা নয়, বরং সমাজের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার দুর্বলতার প্রতিফলন। অশ্বনী কুমারের মতো তরুণ ক্রিকেটাররা যেমন আইপিএলে তাদের প্রতিভা দিয়ে ইতিহাস গড়ছেন, তেমনি সাইবার অপরাধীরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের নতুন পথ খুঁজে বের করছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুলিশ ও সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। তবেই এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই সম্ভব হবে।