অসম, ৭ সেপ্টেম্বর: অসমের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা করিমগঞ্জের (Karimganj) নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীভূমি’ করার সিদ্ধান্তের পর থেকে এই অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করছে। গতকাল, ৬ সেপ্টেম্বর, শ্রীভূমি জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভকারীরা, যাদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের বলে দাবি করা হচ্ছে, জেলার পুরনো নাম ‘করিমগঞ্জ’ ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন।
এই সহিংসতায় পুলিশ ও সাধারণ নাগরিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। এই ঘটনায় প্রায় ১১০ জনকে আটক করা হয়েছে, এবং সাংবাদিক ও পুলিশ সহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীভূমি’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নামকরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া ‘শ্রীভূমি’ নাম থেকে অনুপ্রাণিত, যিনি প্রায় এক শতাব্দী আগে এই অঞ্চলকে ‘মা লক্ষ্মীর ভূমি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী শর্মা এই পদক্ষেপকে জেলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছে এবং এটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে শক্তিশালী করবে।” তবে, এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
৬ সেপ্টেম্বর শ্রীভূমি জেলায় ‘করিমগঞ্জ জেলা নাম পরিবর্তন প্রতিরোধ সমিতি’ নামে একটি সংগঠনের ডাকে ১২ ঘণ্টার বনধ পালিত হয়। এই বনধের সময় বাদারপুরের এন.সি. কলেজের কাছে বিক্ষোভকারীরা জাতীয় সড়ক-৬ এবং জাতীয় সড়ক-৩৭ অবরোধ করে, যার ফলে যান চলাচল ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে এবং স্লোগান দিয়ে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ যখন হস্তক্ষেপ করে, তখন বিক্ষোভকারীরা পুলিশের উপর পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। এই সংঘর্ষে পাঁচ পুলিশ কর্মী সহ মোট ১৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া, সাংবাদিকদের উপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ করে এবং ১১০ জনকে আটক করে, যার মধ্যে একজন কলেজ অধ্যাপকও রয়েছেন।
করিমগঞ্জের নামকরণ ১৯শ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম জমিদার মুহাম্মদ করিম চৌধুরীর নামে হয়েছিল, যিনি কুশিয়ারা নদীর তীরে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সিলেটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, যা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অংশ হয়ে যায়। তবে, করিমগঞ্জ ভারতের সঙ্গে থেকে যায় ত্রিপুরার সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার জন্য।
বিক্ষোভকারীদের একাংশের মতে, ‘শ্রীভূমি’ নামকরণ এই অঞ্চলের মুসলিম ঐতিহ্য মুছে ফেলার একটি প্রচেষ্টা। তারা দাবি করছেন, এই সিদ্ধান্ত জেলার বহুসাংস্কৃতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের পরিপন্থী। কংগ্রেস, বামপন্থী দল এবং স্থানীয় নাগরিক সংগঠনগুলি এই প্রতিবাদে সমর্থন জানিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই বিতর্কের মধ্যেও তাঁর অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি শ্রীভূমি নাম দিইনি, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছিলেন। তাঁর চেয়ে বড় কেউ আছে? আপনার নেতারা কি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন?”
তিনি আরও বলেন, এই নামকরণ অঞ্চলের প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধারের একটি পদক্ষেপ। তবে, বিরোধীদের দাবি, এই পদক্ষেপ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করছে। গত ডিসেম্বরে প্রায় ৩ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে পিটিশন জমা দেওয়া হয়েছিল, এবং এই বছরের শুরুতে প্রতিবাদ কমিটি গঠন করা হয়।
শ্রীভূমি জেলা, যা বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এবং বরাক উপত্যকার অংশ, দীর্ঘদিন ধরে বন্যার সমস্যা, অর্থনৈতিক পশ্চাদপট এবং সীমান্ত সংবেদনশীলতার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই নাম পরিবর্তন বিতর্ক এই অঞ্চলের সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বিক্ষোভকারীদের দাবি এবং সরকারের অবস্থানের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকায় এই উত্তেজনা শিগগিরই কমার সম্ভাবনা কম।
করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে শ্রীভূমি করার সিদ্ধান্ত অসমের রাজনীতি ও সমাজে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যদিও সরকার এটিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানানোর পদক্ষেপ বলছে, বিক্ষোভকারীরা এটিকে তাদের ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে দেখছেন। এই সংঘর্ষ শ্রীভূমির সামাজিক সম্প্রীতির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।