অসমে বাঙালি সম্প্রদায়ের (Bengalis in Assam) ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশ (পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান) থেকে অভিবাসনের ফলে এই রাজ্যে বাঙালি হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়ে উঠেছে। তবে, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (National Register of Citizens – NRC) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (Citizenship Amendment Act – CAA) ২০১৯-এর বাস্তবায়নের ফলে অসমের বাঙালি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এনআরসি এবং সিএএ-এর প্রভাবে অসমের বাঙালিদের পরিচয় সংকট এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব।
এনআরসি: বাঙালি সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব
২০১৩-২০১৯ সাল পর্যন্ত অসমে পরিচালিত এনআরসি হল ভারতের ইতিহাসে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে অসমে বসবাসকারী বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের চিহ্নিত করা। তবে, ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ে, যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ বাঙালি হিন্দু এবং বাকিরা বাঙালি মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের। এই তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিরা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে (Foreigners Tribunals) আবেদন করতে পারেন, তবে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং মানসিকভাবে চাপপূর্ণ।
এনআরসি-র বাস্তবায়ন গরিব এবং শিক্ষিত নয় এমন বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষভাবে কঠিন ছিল। অনেকেই ১৯৭১ সালের আগের নথি, যেমন জন্ম শংসাপত্র, ভোটার তালিকা, বা জমির দলিল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অনেকে তাদের সীমিত সম্পদ, যেমন জমি বা সঞ্চয়, বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলস্বরূপ, বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, এনআরসি-র ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে, যেখানে অনেক বৈধ নাগরিকও তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (AIUDF)-এর একজন বিধায়কের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যা এই প্রক্রিয়ার নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সিএএ: বাঙালি হিন্দুদের জন্য আশা ও বিভ্রান্তি
২০১৯ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আগত হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদানের পথ সুগম করেছে। এই আইন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল, যারা এনআরসি-তে তাদের নাম বাদ পড়ার পর নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে ছিলেন। তবে, এই আইনের বাস্তবায়ন বাঙালি হিন্দুদের জন্য নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। সিএএ-এর নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনকারীদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, যা অনেকের জন্য কঠিন কারণ তাদের কাছে প্রয়োজনীয় নথি নেই। এছাড়া, যারা এনআরসি-তে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তাদের এখন বাংলাদেশী হিসেবে ঘোষণা করতে হলে আইনি সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে পারে।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আইন নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকে মনে করেন যে সিএএ তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণে সহায়তা করবে, কিন্তু অসমের স্থানীয় আসামিয়া সম্প্রদায় এই আইনের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করেন যে সিএএ অসমের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়ের উপর হুমকি সৃষ্টি করবে এবং অভিবাসনের নতুন ঢেউ আনবে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
এনআরসি এবং সিএএ-এর প্রভাব অসমের বাঙালি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব:
- আর্থিক ক্ষতি: এনআরসি-তে নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনেক বাঙালি পরিবার তাদের সঞ্চয় বা সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। প্রক্রিয়াটির জন্য প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, এবং ব্যক্তিগত স্তরে অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন।
- কর্মসংস্থানে বাধা: যারা এনআরসি-তে বাদ পড়েছেন, তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য ফ্রিজ করা হয়েছে, যার ফলে তারা আধার-ভিত্তিক কল্যাণমূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এটি তাদের কর্মসংস্থান এবং জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
- ব্যবসায়িক ক্ষতি: বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়, বিশেষ করে ‘মিয়া’ মুসলিমদের, ব্যবসায়িক বয়কট এবং সামাজিক বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও খারাপ করেছে।
সামাজিক প্রভাব:
- পরিচয় সংকট: বাঙালি সম্প্রদায়, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমরা, ‘বিদেশি’ বা ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে লেবেলযুক্ত হয়েছেন, যা তাদের আসামিয়া পরিচয়ের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে। ‘মিয়া’ শব্দটি বাঙালি মুসলিমদের জন্য অবমাননাকর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: এনআরসি এবং সিএএ ধর্মীয় এবং ভাষাগত বিভেদকে আরও তীব্র করেছে। বাঙালি হিন্দুরা সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার আশা করলেও, বাঙালি মুসলিমরা এই আইন থেকে বাদ পড়েছেন, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে গভীর করেছে।
- মানসিক চাপ: এনআরসি-র প্রক্রিয়া এবং নাগরিকত্ব হারানোর ভয় অনেক বাঙালির মধ্যে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে, এই চাপের ফলে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
অসমের রাজনৈতিক গতিশীলতা
এনআরসি এবং সিএএ অসমের রাজনৈতিক গতিশীলতাকেও প্রভাবিত করেছে। বাঙালি হিন্দুরা ঐতিহাসিকভাবে বিজেপি-র সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এনআরসি-তে বাদ পড়া এবং সিএএ-এর জটিল নথিপত্রের প্রয়োজনীয়তার কারণে তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) এই ইস্যুটিকে ‘বাঙালি-বিরোধী’ হিসেবে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে, আসামিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি, যেমন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU), সিএএ-এর বিরোধিতা করেছে, কারণ তারা মনে করে এটি অসমের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর হুমকি।
এনআরসি এবং সিএএ অসমের বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যদিও সিএএ বাঙালি হিন্দুদের জন্য নাগরিকত্বের পথ সুগম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবে এর বাস্তবায়নের জটিলতা এবং এনআরসি-র ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং পরিচয় সংকট সৃষ্টি করেছে। এই প্রক্রিয়াগুলি অসমের সামাজিক-অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে পুনর্নির্মাণ করেছে, যা ভাষাগত এবং ধর্মীয় বিভেদকে আরও গভীর করেছে। অসমের বাঙালি সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ এই ইস্যুগুলির ন্যায়সঙ্গত সমাধানের উপর নির্ভর করছে।