মানুষ-হাতি সংঘাত মোকাবিলায় অসমে গজ মিত্র প্রকল্প

অসম রাজ্য সরকার মানুষ ও হাতির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত মোকাবিলার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বৃহস্পতিবার অসম মন্ত্রিসভা ‘গজ মিত্র’ প্রকল্পের (Gajah Mitra Scheme)…

Assam’s Gajah Mitra Scheme Targets Human-Elephant Conflict with Sustainable Solutions

অসম রাজ্য সরকার মানুষ ও হাতির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত মোকাবিলার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বৃহস্পতিবার অসম মন্ত্রিসভা ‘গজ মিত্র’ প্রকল্পের (Gajah Mitra Scheme) অনুমোদন দিয়েছে, যা রাজ্যের ৮০টি সংঘাতপ্রবণ এলাকায় হাতির জন্য টেকসই আবাসস্থল তৈরি এবং মানুষ ও হাতির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। এই প্রকল্পের অধীনে হাতির খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন বাঁশ এবং নেপিয়ার ঘাসের চাষের উপর জোর দেওয়া হবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষ এবং হাতি উভয়ের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা হবে।

মানুষ-হাতি সংঘাতের ভয়াবহতা
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অসমে মানুষ-হাতি সংঘাত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (ডব্লিউআইআই)-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই সংঘাতের ফলে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ এবং ১,২০৯টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাতির মৃত্যুর মধ্যে ৬২৬টি মানুষের কারণে ঘটেছে, যার মধ্যে অবৈধ বা অনিরাপদ বৈদ্যুতিক বেড়ার কারণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু সবচেয়ে বড় কারণ। নাগাঁও, সোনিতপুর পশ্চিম, ধানসিরি এবং করবি আংলং পূর্ব অঞ্চলে হাতির মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সময়কালে মোট ৫২৭টি গ্রাম এই সংঘাতের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে গোয়ালপাড়ায় সর্বাধিক ৮০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারপরে সোনিতপুর পশ্চিম (৫৩), সোনিতপুর পূর্ব (৫১) এবং উদালগুড়ি (৩৯)।

   

গজ মিত্র প্রকল্পের উদ্দেশ্য
‘গজ মিত্র’ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হলো হাতির জন্য টেকসই খাদ্য সরবরাহ এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা করা। এই প্রকল্পের অধীনে গোয়ালপাড়া, উদালগুড়ি, নাগাঁও, বাক্সা, সোনিতপুর, গোলাঘাট, যোরহাট এবং বিশ্বনাথ—এই আটটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় ৮০টি সংঘাতপ্রবণ গ্রামে সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল গঠন করা হবে। প্রতিটি দলে আটজন স্থানীয় সদস্য থাকবেন, যারা ধান চাষের মৌসুমে ছয় মাস ধরে কাজ করবেন। এই দলগুলি অহিংস পদ্ধতি ব্যবহার করে হাতির পালকে মানুষের বসতি থেকে দূরে সরিয়ে নিরাপদ পথে পরিচালিত করবে। এছাড়াও, হাতির খাদ্য হিসেবে বাঁশ এবং নেপিয়ার ঘাসের চাষকে উৎসাহিত করা হবে, যাতে হাতিরা মানুষের ফসলের ক্ষতি না করে তাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারে।

সংঘাতের কারণ ও প্রভাব
অসমে মানুষ-হাতি সংঘাতের মূল কারণ হলো হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ক্ষতি এবং খাদ্য ও অভিবাসন করিডোরের সংকোচন। মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে হাতির আবাসস্থল খণ্ডিত হয়েছে। ফলস্বরূপ, হাতিরা খাদ্যের সন্ধানে মানুষের বসতি এবং কৃষিজমিতে প্রবেশ করে, যা ফসল ধ্বংস এবং মানুষ ও হাতির জন্য মারাত্মক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডব্লিউআইআই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮১টি হাতির মৃত্যু আঞ্চলিক সংঘর্ষের কারণে এবং ১৫৮টি মৃত্যু প্রাকৃতিক কারণে ঘটেছে। এই সংঘাতের ফলে কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং জীবনহানি উভয়ই ঘটছে, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হাতির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছে।

সরকারি উদ্যোগ ও হাতি বন্ধু প্রকল্পের প্রভাব
গজ মিত্র প্রকল্প অসমে হাতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিশা প্রদান করবে। এর আগে, ২০১৮ সালে প্রদীপ ভূঁইয়া এবং বিনোদ দুলু বড়া নামে দুই স্থানীয় সংরক্ষণবাদী নাগাঁওয়ে ‘হাতি বন্ধু’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাতির জন্য নেপিয়ার ঘাস, কাঁঠাল এবং হাতি আপেলের মতো খাদ্য চাষ করা হয়েছে, যা হাতিদের মানুষের ফসলের দিকে আকৃষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখছে। হাতিখুলি রংহাং গ্রামে এই উদ্যোগের ফলে গত আট বছরে কোনো মারাত্মক ঘটনা ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন, যা অসমের সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে জাতীয় স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।

Advertisements

গজ মিত্র প্রকল্প এই ধরনের সফল উদ্যোগের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। এটি হাতির আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, সম্প্রদায়ের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অহিংস পদ্ধতির মাধ্যমে সংঘাত হ্রাস করার উপর জোর দেয়। এছাড়াও, সরকার গ্রাম প্রধানদের মাসিক ভাতা ৯,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪,০০০ টাকা করেছে, যা ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে। এটি তাদের দায়িত্ব বৃদ্ধির স্বীকৃতিস্বরূপ।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
মানুষ-হাতি সংঘাত মোকাবিলায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবৈধ বৈদ্যুতিক বেড়া, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ লাইন এবং রেলপথ সম্প্রসারণ হাতির মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এছাড়া, কৃষকদের মধ্যে হাতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং প্রতিশোধমূলক হত্যার ঘটনা সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলছে। গজ মিত্র প্রকল্প এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায় সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করবে এবং সৌরশক্তিচালিত বেড়া, হাতি করিডোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সচেতনতা প্রচারের মতো উদ্ভাবনী সমাধান প্রয়োগ করবে।

এছাড়াও, অসমে হাতি সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ২০২৪ সালে আরণ্যক নামে একটি সংরক্ষণ সংস্থা ‘হাতি অ্যাপ’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে, যা হাতির গতিবিধি সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদান করে এবং গ্রামবাসীদের সতর্ক করে। এই অ্যাপটি গোয়ালপাড়া, চিরাং এবং বাক্সায় প্রাথমিকভাবে চালু হয়েছে এবং এটি সংঘাত কমাতে সহায়ক হয়েছে।

গজ মিত্র প্রকল্প অসমে মানুষ-হাতি সংঘাত মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি হাতির জন্য টেকসই আবাসস্থল তৈরি, সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং অহিংস পদ্ধতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে অসম সরকার এই উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রকল্প সফল হলে, অসম কেবল হাতি সংরক্ষণে নয়, বরং ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে একটি উদাহরণ স্থাপন করবে।