গুয়াহাটি: অসমের গোলপাড়ায় ফের শুরু হল রাজ্য সরকারের ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান। রবিবার সকাল থেকেই দহিকাটা রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় প্রায় ১,১৪০ বিঘা (৩৭৬ একর) জমি জুড়ে চলে এই অভিযান। প্রশাসনের দাবি, এই জমিতে অবৈধভাবে বসবাস করা ৫৮০টি পরিবারকে সরানো হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই আগেই নোটিশ পাওয়ার পর নিজ উদ্যোগে এলাকা ছেড়ে গিয়েছেন।
জেলা শাসক প্রদীপ তিমুং জানিয়েছেন, “উচ্ছেদ অভিযান শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নোটিশ পাওয়ার পর নিজেরাই জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিদের বাড়িঘর আজ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আমরা পুরো এলাকা পাঁচটি ব্লকে ভাগ করেছি, যার চারটিতেই প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই এলাকা ছেড়েছেন।”
মোদীর সভায় গেলে পরীক্ষায় অতিরিক্ত ৫০ নম্বর? ভাইরাল নোটিশে তোলপাড় দেশ!
অভিযান ঘিরে এলাকা জুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দশাধিক এক্সকাভেটর, ট্র্যাক্টর এবং বড়সড় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে প্রশাসন জানিয়েছে, এই অভিযান গৌহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে একাধিক মামলা ও অভিযোগ জমা পড়েছিল বনভূমি দখল নিয়ে।
তবে সরকারি বক্তব্যের বাইরে অন্য এক বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে স্থানীয়দের মুখে। উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের অনেকেই বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত, যাদের দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় বসবাসের ইতিহাস রয়েছে। আবদুল করিম, এক উচ্ছেদপীড়িত বাসিন্দা বলেন, “আমরা এখানে দশকের পর দশক ধরে থাকছি। সরকার যদি মনে করে আমরা দখলদার, তবে বিদ্যুৎ, শৌচালয় আর আধার কার্ড কেমন করে পেলাম? সরকারই তো এগুলো দিয়েছিল।” তাঁর কথায়, “আমাদের কাছে ভূমির দলিলও আছে। কিন্তু আজও আমাদের ‘বাইরের লোক’ বলা হয়। এখন আমরা কোথায় যাব?”
সরকারি পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, দহিকাটা রিজার্ভ ফরেস্টের এই জমি হাতির করিডোরের মধ্যে পড়ে, এবং সেখানে মানব বসতি থাকার ফলে মানুষ-হাতি সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছিল। রাজ্যের বিশেষ মুখ্যসচিব (বন বিভাগ) এম.কে. যাদব বলেন, “এই এলাকা খালি করলে হাতির চলাচলে বাধা কমবে, ফলে সংঘর্ষও অনেকটাই কমে যাবে।”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরনের উচ্ছেদ অভিযানকে সমর্থন করছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘অবৈধ মিয়া’দের দখল করা জমি মুক্ত করাই তাঁর সরকারের অঙ্গীকার। জুলাই মাসে তিনি দাবি করেন, গত চার বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ১.২৯ লক্ষ বিঘা জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, যদিও এখনও প্রায় ২৯ লক্ষ বিঘা জমি অবৈধ দখলে রয়েছে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই অভিযানগুলির লক্ষ্যবস্তু প্রায় সবসময়ই বাংলাভাষী মুসলিম পরিবার, যাদের ‘মিয়া’ বলে চিহ্নিত করা হয়। “মিয়া” শব্দটি আগে অবমাননাকর অর্থে ব্যবহৃত হলেও, সম্প্রতি সমাজের একাংশ তা আত্মপরিচয়ের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই ধরনের উচ্ছেদ অভিযান “নির্বাচনী রাজনীতির হাতিয়ার” হয়ে উঠেছে। বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর অনেকেরই এখন মাথার উপর ছাদ নেই, এবং সরকারের তরফে তাদের পুনর্বাসনের কোনও পরিকল্পনা এখনও ঘোষণা করা হয়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গোলপাড়ার এই উচ্ছেদ অভিযান শুধুমাত্র বনভূমি রক্ষার প্রশ্ন নয়, বরং এটি আসামের চলমান জাতিগত ও ধর্মীয় রাজনীতির গভীর প্রতিফলন।
