গ্রামে রাস্তা নেই! হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই প্রসব বিজেপি শাসিত রাজ্যে

সভ্যতার দম্ভে ভর করে উন্নয়নের ঢাক পিটানো হয়, কিন্তু বাস্তবটা যে কতটা নির্মম তা আবারও প্রমাণিত হল মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) সিধি জেলার ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম…

ambulance arrived on time but couldn't enter the village due to a lack of road

সভ্যতার দম্ভে ভর করে উন্নয়নের ঢাক পিটানো হয়, কিন্তু বাস্তবটা যে কতটা নির্মম তা আবারও প্রমাণিত হল মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) সিধি জেলার ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম বারিগওয়ানে। এই গ্রামে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা শুধু একজন মহিলার যন্ত্রণার কাহিনি নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ব্যর্থতার দলিল।

আদিবাসী মহিলা প্রীতি রাওয়াত সন্তানসম্ভবা অবস্থায় ছিলেন। প্রসব বেদনা উঠলে তাঁর পরিবার দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাস্তাঘাটের এমন হাল যে, হাসপাতালে পৌঁছনো তো দূরের কথা, অ্যাম্বুলেন্সও গ্রামে ঢুকতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গ্রাম থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে, কাদা আর পিচ্ছিল জমির বাধা পেরিয়ে, একজোড়া বাঁশ আর দড়ি দিয়ে তৈরি দোলনায় চাপিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়েছিল মূল সড়কে, কিন্তু পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাসপাতালের দরজার বদলে অ্যাম্বুলেন্সেই সন্তান প্রসব করেন প্রীতি। সৌভাগ্যবশত, মা ও শিশু দুজনেই এখন সেমরিয়া হাসপাতালে স্থিতিশীল অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

   

এই ঘটনা শুধু একটি পরিবারের দুর্ভোগের ছবি নয়, বরং প্রশ্ন তোলে গোটা রাজ্যের পরিকাঠামো, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং তথাকথিত উন্নয়নের দাবির বিরুদ্ধে।

বর্ষার মরসুমে বিভীষিকায় দিন কাটে বারিগওয়ানবাসীর
গ্রামটি সিধি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। প্রায় ৭০ জন বাসিন্দার বেশিরভাগই আদিবাসী। বর্ষা এলেই তাঁদের জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। কাদা, জল আর দুর্গম রাস্তার কারণে স্কুল, বাজার বা হাসপাতালে যাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ছোট ছোট শিশুরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। চিকিৎসার প্রয়োজনে যদি সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছনো না যায়, তাহলে মৃত্যুই যেন ভবিতব্য।

‘অ্যাম্বুলেন্স এলেও ঢুকতে পারেনি গ্রামে’, জানালেন চিকিৎসা আধিকারিক
সিধির চিফ মেডিক্যাল অ্যান্ড হেলথ অফিসার, ডা. ববিতা খারে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, অ্যাম্বুলেন্স সময়মতো পৌঁছেছিল, কিন্তু গ্রামে ঢোকার কোনো রাস্তা না থাকায় তারা মূল সড়কেই থেমে ছিল। এই অমানবিক পরিস্থিতিকে ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করেছেন সমাজকর্মী প্রভাত বর্মা। তাঁর কথায়, “পরিবার যদি তৎপরতা না দেখাত, তাহলে মা ও শিশুকে হয়তো হারাতেই হত।”

এটাই প্রথম নয়: বারবার উঠে আসছে সিধির দুরবস্থা
এই ঘটনা নতুন নয়। সিধি জেলায় এমন বহু ঘটনা আগেও সামনে এসেছে। কেবল কয়েক সপ্তাহ আগেই, একসঙ্গে ৮ জন গর্ভবতী মহিলা প্রতিবাদে নেমেছিলেন রাস্তা চেয়ে। তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঘেলি কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সমাজকর্মী লীলা সাহু। তাঁর প্রতিবাদ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। তবে বিজেপির সাংসদ ডাঃ রাজেশ মিশ্রের অবমাননাকর মন্তব্যে ক্ষোভ আরও বাড়ে। তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক ডেলিভারির একটা নির্ধারিত তারিখ থাকে, আমরা এক সপ্তাহ আগে নিয়ে নেব।”

Advertisements

এই মন্তব্যে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছড়ালেও বাস্তব পরিবর্তন কিছুই হয়নি। বরং লীলা সাহু, যিনি নিজেই এখন ৯ মাসের গর্ভবতী, তিনদিন আগেই একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, “এমপি সাহেব, আপনি বলেছিলেন হেলিকপ্টার পাঠাবেন, এবার পাঠান।”

প্রশাসনের ‘উদাসীন’ প্রতিক্রিয়া
জনগণের ক্ষোভে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। কিন্তু তাতেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। রাজ্যের জনপথ দফতরের মন্ত্রী রাকেশ সিং মন্তব্য করেন, “কেউ যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয়, তাহলে কি আমরা ডাম্পার বা সিমেন্ট প্ল্যান্ট নিয়ে পৌঁছে যাব? এভাবে তো হয় না।”

এই মন্তব্যও পরিষ্কার করে দেয়, প্রশাসনের কাছে সাধারণ মানুষের কষ্ট, বিশেষ করে আদিবাসী অঞ্চলের মানুষদের সমস্যা কতটা গুরুত্বহীন।

উন্নয়নের স্বপ্ন বনাম বাস্তবের ধাক্কা
রাজ্যে একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা হয়, নানা উন্নয়নের গল্প শোনানো হয়, কিন্তু বাস্তবতা হল, আদিবাসী মহিলারা কাদার রাস্তা বেয়ে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত যেতে বাধ্য হন সন্তান জন্ম দিতে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘লাডলি বেনা’ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচারে যতখানি আগ্রহ, বাস্তবে গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়নে তার সামান্যও দেখা যায় না।

এই ঘটনা শুধুই প্রীতি রাওয়াতের নয়, গোটা দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর চূড়ান্ত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। বারিগওয়ান যেন আয়নায় দেখিয়ে দিল—উন্নয়নের আস্ফালন নয়, বাস্তব পরিষেবা চাই মানুষের বাঁচার জন্য। এখন প্রশ্ন একটাই—আর কত প্রাণ ঝরে গেলে জেগে উঠবে প্রশাসন?